সিজারের পর প্রসূতির মৃত্যু, ৪ লাখ টাকায় রফাদফা

রাজবাড়ী শহরের সজ্জনকান্দা বড়পুল এলাকায় অবস্থিত ডা. রতন ক্লিনিকে ফের ‘ভুল চিকিৎসায়’ শাহানা বেগম (২৭) নামের এক সিজারিয়ান রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে রোগীর পরিবারকে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ৪ লাখ টাকা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) রাত ৮টার দিকে ডা. রতন ক্লিনিকে শাহানা বেগমের সিজারিয়ান অপারেশন করেন ওই ক্লিনিকের মালিক ডা. রইসুল ইসলাম রতন। এরপর রোগীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
মৃত শাহানা বেগম রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের বেথুলিয়া মুন্সিপাড়া গ্রামের সাঈদ সরদারের মেয়ে। তিনি পাবনার ঢালারচরের ওমর ফারুকের স্ত্রী।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শাহানা বেগম গর্ভবতী হলে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি রামকান্তপুর ইউনিয়নের বেথুলিয়া মুন্সি পাড়ায় নিয়ে আসা হয়। গত মঙ্গলবার রাতে শাহানার প্রসব বেদনা উঠলে ওই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। কিন্তু শাহানা নরমালে বাচ্চা প্রসব করার অবস্থায় না থাকলে তাকে সদর হাসপাতাল থেকে যে কোনো একটি ক্লিনিকে নিয়ে সিজার করতে বলা হয়। পরে বুধবার সন্ধ্যার পর শাহানার পরিবারের লোকজন তাকে রাজবাড়ী শহরের বড়পুল ডা. রতন ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে ওই ক্লিনিকের মালিক ডা. রইসুল ইসলাম রতন নিজেই শাহানাকে সিজারিয়ান অপারেশন করেন। এ সময় সহকারী সার্জন হিসেবে ছিলেন ডা. রাবেয়া আক্তার তামান্না এবং অ্যানেসথেসিয়া করেন ডা. নিয়ামত উল্লাহ। সিজারের সময় অপারেশন থিয়েটারে ডিপ্লোমা সিস্টার রত্না ও ইবিকা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন
ওইদিন রাত ৮টার দিকে শাহানা সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। পরবর্তীতে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বাচ্চাটিকে পরিবারের কাছে দেন। ওই দিকে শাহানার অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বুঝতে পেরে তারাই অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে শাহানাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে রাত ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহানা মৃত্যু হয়।
মৃত শাহানার মেয়ে জেসমিন আক্তার বলেন, আমার মা সুস্থ ছিলেন। সিজারের পর তিনি মারা যান। তবে আমার ভাই সুস্থ আছে।
শাহানার শাশুড়ি রাবেয়া বেগম বলেন, আমার ছেলের বউ শাহানা শারীরিকভাবে সুস্থ ছিল। তাকে নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রথমে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নরমাল ডেলিভারি না হওয়ায় তাকে রতন ক্লিনিকে নেওয়া হয়৷ সেখানে তাকে সিজারিয়ান অপারেশন করলে ছেলে হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ জানায়, আমার ছেলের বউয়ের শারীরিক অবস্থা ভালো নাই। তখন তারাই অ্যাম্বুলেন্সে ফরিদপুরে নিয়ে যায়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এখন এই শিশু বাচ্চাটার কি হবে। দুধের শিশু জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে পারলো না।
মৃত শাহানার স্বামী ওমর ফারুক বলেন, সকালেই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে আমাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আপস-মীমাংসা করে ফেলেছে। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।
এ বিষয়ে রামকান্তপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আজিজুল ইসলাম বলেন, ডা. রতন ক্লিনিকে সিজারের সময় শাহানা বেগম নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি আমার ওয়ার্ডেই। তবে এ বিষয়ে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ওই পরিবারের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে ফেলেছে বলে জানতে পেরেছি।
অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. নিয়ামত উল্লাহ বলেন, শাহানা নামের ওই রোগীর অ্যানেসথেসিয়া আমিই করেছিলাম। রোগীর ওটির মধ্যে দুইবার খিঁচুনি হয়। ওটি শেষে বেডে দেওয়ার সময় আরেকবার খিঁচুনি হয়। তখন তার শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে তাকে ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে ওই রোগী এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
এ বিষয়ে ডা. রইসুল ইসলাম রতনের বক্তব্য নিতে তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
ক্লিনিকের ম্যানেজার আকলিমা আক্তার তমা রোগীর মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া অর্থের বিনিময়ে বিষয়টি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ রোগীর পরিবারের সঙ্গে ৪ লাখ টাকায় আপস-মীমাংসা করে মিটিয়ে ফেলেছেন বলেও জানান।
এ বিষয়ে রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. এস এম মাসুদ বলেন, এ বিষয়ে রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, এর আগেও ডা. রতন ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা ও ভুল অপারেশনে একাধিক রোগীর অকাল মৃত্যুর ঘটনায় ক্লিনিকে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও বিভিন্ন উপায়ে তা ধামাচাপা দেওয়া হয়। অহরহ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় এই ক্লিনিক ‘কিলখানা’ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পেয়েছে। গত ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আম্বিয়া আক্তার বীনা (২৫) নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়। ওই রোগীর সিজার করেছিলেন ডা. রতন নিজেই। ওই ঘটনাটিও তারা টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া টনসিল অপারেশনসহ অন্যান্য অপারেশন করতে রোগী মৃত্যুর ঘটনা এই ক্লিনিকে রয়েছে। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ উদাসীন থাকায় সচেতন মহলে ও ভুক্তভোগীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/এএমকে