ফেনীর জনপদে বন্যার ক্ষত, কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদে যত ক্ষতি

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার বছর না পেরোতে ফের পানিতে ডুবেছে ফেনীর জনপদ। টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও ফেনী সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। প্রবল পানির তোড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষক, মৎস্যজীবী ও গবাদিপশু পালনকারীরা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্যাদুর্গত এলাকায় এবারও কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে কোটি টাকা।
কৃষিতে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারের বন্যায় জেলায় আউশ ৮৪৫ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৫৩৭ হেক্টর, মরিচ ১৪ হেক্টর, আদা ৭ হেক্টর, হলুদ ২ দশমিক ৫ হেক্টর, টমেটো ০ দশমিক ১১ হেক্টর, আমন বীজতলা ৬৮৯ হেক্টর এবং বস্তায় সংরক্ষিত আদা ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টরসহ মোট ৫ হাজার ৫৬৪ দশমিক ৬১ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফুলগাজীর দরবারপুর ইউনিয়নের কৃষক কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বন্যায় ৩ বিঘা জমির আমন ধানের বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিবছরই বন্যার কারণে আমাদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতির সঙ্গে পরিবার নিয়ে বড় ধরনের আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা কৃষক হিসেবে বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে সরকারি সহায়তা ও কার্যকর পদক্ষেপের দাবি করছি।

পরশুরামের ধনীকুন্ডা এলাকার কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমার ৫ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। বছর না ঘুরতেই আবারও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি। এভাবে হলে আমদের না খেয়ে থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ বলেন, এখনো অনেক এলাকায় পানি রয়েছে। বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র ও আর্থিক পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে। আমরা ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসেব নিচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দেওয়া হবে।
মৎস্য খাতে ক্ষতি প্রায় ৯ কোটি টাকা
জেলা মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এখন পর্যন্ত ফেনী জেলায় মৎস্য খাতে ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। জেলার ছয়টি উপজেলায় ২ হাজার ৩৩০টি পুকুর, দিঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে ২৭৬ দশমিক ২০ মেট্রিক টন মাছ। যার আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ ছাড়া, বন্যায় ১২৮ মেট্রিক টন পোনা মাছ ভেসে গেছে, যার আর্থিক মূল্য ৩ কোটি ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া খামারগুলোর বিভিন্ন অবকাঠামোতেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এতে ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।
ফুলগাজীর মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের মাছচাষি আলমগীর বলেন, তিনটি পুকুরের আয়তন প্রায় ৩ বিঘা। এবারের বন্যায় সবগুলো পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিভাবে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠব বুঝতে পারছি না।

পরশুরাম উপজেলার পশ্চিম অলকা গ্রামের মাছচাষি হাসিবুর রহমান বলেন, বন্যার কারণে পুকুরের চারপাশে নেট জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম। তবে বাঁধ ভেঙে পানির তীব্র স্রোতে তা কাজে আসেনি। সবকিছু পানিতে ভেসে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের পাশে না দাঁড়ান, তবে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। গেল বছরের বন্যায়ও তেমন সহায়তা পাইনি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতে কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে তালিকা পাঠানো হবে।
বন্যায় মারা গেছে সাড়ে ১০ হাজার মুরগি, প্রাণিসম্পদে ক্ষতি প্রায় ৬৫ লাখ
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, এবারের বন্যায় জেলায় মোট ১০ হাজার ৬০০টি মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ফুলগাজীতে ১ হাজার ৪০০টি, পরশুরামে ৭ হাজার ২০০টি ও ছাগলনাইয়ায় ২ হাজার মুরগি মারা যায়। এ ছাড়া জেলায় বন্যায় ২৩৫টি হাঁস, ৩টি ছাগল, ১টি ভেড়া ও ৪টি গরু মারা গেছে। প্রাণিসম্পদের খাদ্যেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। পশুপাখির ৭ টন দানাদার খাদ্য নষ্ট হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। পাশাপাশি ৩০ টন খড় নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বিনষ্ট হয়েছে ১৬০ টন ঘাস, যার আনুমানিক মূল্য ৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে প্রাণিসম্পদে এবার মোট ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

মুন্সীরহাট ইউনিয়নের কমুয়া চানপুর গ্রামের রাসেল বলেন, আমার একটি গরু পানিতে ডুবে মারা গেছে।আয়-রোজগারে ভরসা ছিল এটিই। এখন একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে গেছি। প্রতিবছরই বন্যা হয়, আর আমাদের এভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে এ সংকট কখনো কাটবে না।
বিজয়পুর এলাকার বিসমিল্লাহ পোল্ট্রি খামারের স্বত্বাধিকারী হাসান বলেন, বন্যার পানিতে খামারে থাকা ১ হাজার ৫০০ মুরগি মারা গেছে। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর স্বপ্ন এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আরও পড়ুন
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাত এবারও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য প্রাণিসম্পদে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫০ টাকা নিরূপণ করা হয়েছে। এ ক্ষতির চিত্র আরও বাড়তে পারে। দাপ্তরিকভাবে কোনো ধরনের প্রণোদনা বা সহায়তা বরাদ্দ হলে তা ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ও প্রান্তিক খামারিদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এর আগে গত মঙ্গলবার (৮ জুলাই) থেকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি অংশে ভাঙনে বন্যাকবলিত হয় জেলার পাঁচটি উপজেলা।
তারেক চৌধুরী/এএমকে