৫০ লাখ টাকা দিলেও আমার ছেলেকে আর পাব না

‘আমার ছেলে ঢাকায় থাকতো। মাসে মাসে টাকা পাঠাইতো, আরও অনেক কিছু দিত। এখন আর বলেনা মা তুমি কি খাবা? তোমার জন্য আমি কি পাঠামু? আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, কিন্ত ছেলেকে আর খুঁজে পাইনা। এতিম নাতিরা কয় চাচ্চুরা ঢাকা থেকে আইছে, আব্বু কেনো আসেনা। তাদের বাবার আদর কে দেবে? আমারে ৫০ লাখ টাকা দিলেও আমি আর আমার ছেলেকে পাব না।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিলেন, ঢাকায় জুলাই ২৪ এর আন্দোলন চলাকালীন সহিংসতায় গুলিতে শহীদ মো. মিজানুর রহমানের মা মোসা. শাহিনুর বেগম।
তিনি বলেন, আমার ছেলে আমাকে যেভাবে আদর যত্ন করছে তা আর কে করবে? কোনো সরকারই তা করতে পারবে না। আমি চাই আমার ছেলের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান নিয়ে যেনো একটু সুখে দিন কাটাতে পারি। কোনো মায়ের বুক এভাবে যেনো আর খালি না হয়। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, সরকারের কাছে তাদের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাই।
আন্দোলনে শহীদ মো. মিজানুর রহমান বরগুনা সদর উপজেলার ৮ নম্বর ইউনিয়নের কালিরতবক এলাকার বাসিন্দা মো. দুলালের বড় ছেলে। মৃত্যুর প্রায় ৮ বছর আগে জীবিকার তাগিদে বরগুনা ছেড়ে কাজের উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তিনি ঢাকায় যান। পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে মিজানুর ঢাকায় থেকে যখন যে কাজ পেতেন তখন সেই কাজই করতেন। তবে বেশিরভাগ সময় বাবার সঙ্গে ঠেলাগাড়ি চালানোর কাজ করতেন তিনি।

গত বছরের ২০ জুলাই মিজানুর প্রতিদিনের মতোই সকাল ৮টার দিকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবাকে বাসায় রেখে কাজের উদ্দেশ্যে বের হন। কাজ শেষে বিকেলে বাসায় ফেরার পথে মানিকনগর বিশ্বরোড এলাকায় আন্দোলন চলাকালীন তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে সঙ্গে থাকা কয়েকজন মিলে তাকে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ওই দিন রাতেই মিজানুরের মরদেহ বরগুনার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসেন স্বজনরা। পরদিন সকালে নিজ গ্রামের বাড়িতে মিজানুরকে দাফন করা হয়।
শহীদ মিজানুরের গ্রামের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, ৯ বছর বয়সী মেয়ে সামিয়া আক্তার পিংকি আর ৫ বছর বয়সী ছেলে সাজিদুল ইসলাম এখনো ভুলতে পারেনি বাবার স্মৃতি। মাঝেমধ্যে ছবি দেখিয়ে নাতিদের সান্ত্বনা দেন মিজানুরের বাবা-মা। অপরদিকে ছেলে হারানোর স্মৃতি মনে পড়লেই কবরের কাছে ছুটে গিয়ে এখনো কান্নায় বুক ভাসান মিজানুরের মা শাহিনুর বেগম। শহীদ মিজানুরের গ্রামে বাড়িতে তার নিজের কোনো ঘর না থাকায় দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে দেবরের বাড়িতেই থাকেন স্ত্রী জাকিয়া আক্তার শিরিন।
স্বামী হারানো বেদনা নিয়ে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তে চিন্তিত মিজানুরের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার শিরিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের থেকে এখন আমাদের অবস্থা কিছুটা ভালো। সরকারিভাবে যে সহযোগিতা পাচ্ছি তা দিয়ে মোটামুটি চলতে পারি। কিন্তু টুকটাক এমন সহযোগিতা দিয়ে তো আর সারাজীবন চলা যাবে না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আছে, ছেলে-মেয়েসহ নিজের পেছনেও ওই সহযোগিতার টাকা খরচ হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমার শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দেবরের বাসায় আছি। আমার নিজের কোনো ঘর নাই। ভবিষ্যতে যাদি শ্বশুর শাশুড়ি মারা যায় তখন আমার ছেলে-মেয়ের স্থান কোথায় হবে। এ কারণে সরকার যদি আমাকে থাকার একটা জায়গা করে দেয় পাশাপাশি একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে মাসে মাসে একটা টাকা আয়ের মাধ্যম তৈরি হবে। যা দিয়ে অন্তত ছেলে মেয়ের থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতো। মা হিসেবে বাবার মতো করেই আমার ছেলে মেয়ের পাশে দাঁড়াতে চাই। সরকার যদি এমন কিছুর উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও আমার সন্তানদের বাবার অভাব পূরণ করতে পারবো।
আরও পড়ুন
শহীদ মিজানুর রহমানের বাবা মো. দুলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর ২০ জুলাই আমার ছেলে মারা গেছে। বর্তমান সরকার আমাদের পাশে আছে এবং ভালোই সহযোগিতা করছে। প্রতি মাসেই আমাদের খোঁজ খবর নেয় তারা। এছাড়াও ১০ লাখ টাকার একটা সঞ্চয়পত্র দিয়েছে, যা দিয়ে মাসে ৯ হাজার ৩৭০ টাকা পাই। কিন্ত ওই টাকা দিয়ে শুধু মিজানুরের দুই সন্তানের লেখা পড়ার খরচ হয়। আমি সবল থাকায় বাকিসব খরচ চালাতে পারছি। তবে ভবিষ্যতে আমি না থাকলে তখন কি হবে? আর একারণেই প্রত্যেক শহীদ পরিবারের অন্তত একজনের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আমি আহ্বান জানাই।
মো. আব্দুল আলীম/এমএন