দায়িত্বশীল ছেলেটি এখন শহীদ: অঝোর ধারায় কাঁদছে মা-বাবা, ভাঙা ঘরে নেই হাসি

ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের ছোট্ট নিভৃত গ্রাম শীরযুগ। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, পাখির কিচিরমিচির, গ্রামের একটুখানি সরলতা। তবে এই সৌন্দর্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক পরিবারের গভীর শোক, বেদনা আর অপূরণীয় শূন্যতা।
এই গ্রামের একটি ঘরে আজ আর কোনো হাসি নেই, নেই আনন্দের চিহ্ন। শুধু চোখের জলে ভিজে থাকা মা-বাবা, ভাই-বোন আর স্তব্ধ একটা উঠান। এই ঘরেই বড় হয়েছিলেন হৃদয় হাওলাদার। তার বাবা-মা কখনো তাকে ‘হৃদয়’ বলে ডাকেনি— মা ডাকতেন ‘বাবা’, বাবা ডাকতেন ‘বাবা’। সেই বাবা এখন আর নেই। সে এখন শহীদের তালিকায়, একটি রক্তাক্ত আন্দোলনের গল্প হয়ে আছে মানুষের স্মৃতিতে।
গত বছর ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মো. হৃদয় হাওলাদার।
বাবা মো. শহীদ হাওলাদার কেঁদে কেঁদে বলেন, হৃদয় ঢাকায় একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতো। অল্প অল্প করে টাকা জমাতো। বলতো, বিদেশে যাবে, টাকা পাঠাবে, আমাদের ঘরটা ঠিক করবে। ঘরে বৃষ্টির সময় টিন দিয়ে পানি পড়ে। ছেলে বলেছিল, ‘বাবা, একটু ধৈর্য ধরো, আমি টাকা পাঠালে ঘর মেরামত করে নিও।’ আজ সেই ঘর আগের মতোই ভাঙা পড়ে আছে, কিন্তু আমার ছেলে আর নেই।
অপরদিকে হৃদয়ের মা কুলসুম বেগম আজো হঠাৎ দরজায় তাকিয়ে ভাবেন, ছেলে বুঝি ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, ওর ফোন আসতো সকালে, বলতো— ‘মা, ভাত খেয়েছো?’ আমি বলতাম, ‘খেয়েছি বাবা, তুই খেয়েছিস?’ ও বলতো, ‘আমি দোকানে এসেছি মা। সন্ধ্যায় ফোন দেব।’ তারপর কত সন্ধ্যা এলো, কিন্তু সেই ফোন আর আসে না।
অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বললেন, ওর কাপড়গুলো এখনো ধরি। গন্ধ পাই, মনে হয় বুকের ভেতর ঢুকে আসে। কত রাত ঘুম ভেঙে কাঁদি। চোখ মুছে তাকাই দরজার দিকে— ভাবি, হঠাৎ বুঝি দরজা খুলে বলবে, ‘মা, ঢাকা থেকে চলে আসছি।’ কিন্তু না, দরজা খোলে না, আমার বাবাও আসে না।
ঢাকার কালশী কবরস্থানে হৃদয়কে কবর দেওয়া হয়। তার মরদেহ নিজ গ্রামে আনাও সম্ভব হয়নি বলে জানান বাবা মো. শহীদ হাওলাদার।
তিনি বলেন, যেদিন হৃদয় দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেল, কোনো অ্যাম্বুলেন্স রাজি হলো না, হাসপাতালে ঢুকতেও দেয়নি। টাকাও ছিল না যে ফ্রিজিং করে রাখব। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ঢাকার মিরপুর-১১ এর মাক্কী মসজিদে ফজরের নামাজের পর শতশত মুসল্লির উপস্থিততে কালশী কবরস্থানে হৃদয়কে দাফন করতে হয়। এখন কবরটাও ঠিকমতো দেখি না, এতদূরে যাওয়া আমাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, আমরা সরকারের কাছে আবেদন করি— অন্তত আমাদের ছেলের কবরটা যেন সংরক্ষণ করা হয়। এই ছেলেটা তো দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, তার স্মৃতিটা যেন হারিয়ে না যায়। আমরা শুধু চাই ছেলের রক্তটা বৃথা না যাক।
শহীদ হাওলাদার বলেন, আর্থিক সহযোগিতা কিছু পেয়েছি, তবে স্থায়ী ভাতাটা হলে আমরা একটু স্বস্তি পেতাম। সরকার ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। স্থানীয় প্রশাসনও খোঁজ নিয়েছে একাধিকবার। তবে এখন একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চাই।
তিনি আরও বলেন, শুনেছি সরকার নাকি শহীদদের পরিবারের জন্য স্থায়ী ভাতা চালু করবে। যদি সেটা হয়, তাহলে অন্তত আমার ছোট ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎটা একটু গুছিয়ে নিতে পারব। আমার নিজের শরীরও বেশি ভালো না। কাজ করতে পারি না। ছেলেটার ওপর নির্ভর ছিলাম।
হৃদয়ের ছোট ভাই স্কুলপড়ুয়া রিয়াদ হাওলাদার বলেন, ভাইয়া বলতো, আমার জন্য নতুন বই কিনে দেবে। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করলে পুরস্কার দেবে। এখন আমি কিছুই চাই না, শুধু চাই ওর মতো সাহসী হতে, বাবা-মা বোনদের দায়িত্ব নিতে।
পরিবার চায়, হৃদয়ের মতো শহীদদের যেন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়, তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।
মা কুলসুম বেগম বলেন, আমার বাবার নাম যদি শহীদের তালিকায় থাকে, তাহলে অন্তত বুকের ভেতর শান্তি পাব। আমি চাই না আর কোনো মা হারাক তার ‘বাবা’কে। যদি সরকার আমাদের পাশে থাকে, তাহলে হয়তো আমরা একটু বাঁচতে পারব। আর এই রক্ত যেন মাটিতে না মিশে যায়, এই ত্যাগ যেন ইতিহাসে লেখা থাকে।
মো. শাহীন আলম/এমজে