বিপ্লবীদের মাঝে ছেলেকে খুঁজে বেড়ান শহীদ সাগরের বাবা

জুলাই গণঅভ্যুত্থাণে ময়মনসিংহের রাজপথে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কলেজ শিক্ষার্থী রিদওয়ান হোসেন সাগর (২৩)। তিনিই ময়মনসিংহ নগরীর একমাত্র শহীদ। তার মৃত্যুকে ঘিরেই সেদিন আন্দোলনের মাঠে সহকর্মীদের মাঝে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়েছিল। তবে একমাত্র ছেলে সন্তান হারানোর বেদনায় এখনো কাতর শহীদ সাগরের বাবা-মা।
শনিবার (২ আগস্ট) বিকেলে ময়মনসিংহ নগরীর চৌরাঙ্গী মোড়স্থ শহীদ সাগারের বাসায় গিয়ে তার বাবা মো. আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ সময় শহীদ ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ওপর আক্রমণ করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমার ছেলে হারানোর বেদনা আমি বুঝি। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার না। যা হারাইছি, তা আর পাব না। তবে ছেলে হারানোর পর থেকে তার আন্দোলনের সহযোদ্ধারা আমাদের খোঁজখবর নেয়, ডাকে- আমিও যাই। ওই বিপ্লবীদের মাঝেই খুঁজে ফিরি আমার ছেলের মুখ। ওরা আমাকে বাবা, চাচা বলে ডাকে। ছেলে হারানোর শোক ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে, প্রফুল্ল রাখতে চায়। কিন্তু বাবা-মা কখনো ছেলে হারানোর শোক ভুলতে পারে না- বলেই তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠেন।
এ সময় তার ছেলের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই আমার ছেলে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এর আগের দিন ১৮ জুলাই স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্ত ঢাকা থেকে এসে তার বাসায় গোপন বৈঠন করে। এর পর দিন তারা ছাত্রদের মিছিল ঠেকাতে অস্ত্র হাতে মাঠে নেমে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই আমার ছেলে মারা যায়। এরপর দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত আমার ছেলে লাশ ফুটপাতে পড়েছিল। এই কষ্ট কাউকে বলে বুঝানো যাবে না। ওই হামলায় আহত হয়েছিল আরও অনেক শিক্ষার্থী। তাদের অনেকের হাত ও পা কেটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের চিকিৎসা নিতেও দেওয়া হয়নি। ফলে অনেকেই এখন পঙ্গুত্ববরণ করে জীবনযাপন করছে।
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, আন্দোলনে ছেলে শহীদ হবার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা, প্রশাসন সবাই আমার খোঁজখবর নেয়। তারা সবাই আমার পরিবারের প্রতি যত্নশীল। এজন্য রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
ছেলে হত্যার বিচার প্রসঙ্গে এই শহীদ বাবা বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। আমি কারো কাছে বিচারপ্রার্থী না। একজন মুসলমান হিসাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে সব বিচার দিয়ে দিয়েছি। তবে আমার ছেলের মৃত্যু স্বাভাবিক না। গত ৫ আগস্টের আগে এবং পরে অনেকেই আমাকে মামলা করতে বলেছে, কিন্তু অন্যরা মামলা করলেও আমি মামলা করিনি। আমার স্ত্রী ক্যান্সার আক্রান্ত। ছেলে শোকে সে এখন পাথর। এক মেয়ে অর্নাসে পড়ছে। মৃত্যুর পর আমার ছেলের ময়নাতদন্ত হয়নি। এখন আর আমার ছেলের লাশ কবর থেকে তুলে কাটাছেঁড়া হোক, সেটা আমরা চাই না। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সবাইকে আমি লিখিতভাবে ঘটনাটি জানিয়েছি। বিচার আল্লাহ করবে। দুঃখ একটাই, আমার ছেলে হত্যার ঘটনাটি সে সময় অনেকেই সামনে থেকে দেখেছে কিন্তু কেউ মুখ খুলে না, সত্য বলে না। শহরের সবচেয়ে বেশি সিসি ক্যামেরা ছিল ওই সড়কে। কিন্তু ঘটনার পর সব ফুটেজ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, গেল বছরের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সারাদেশের ন্যায় ময়মনসিংহ নগরীর ছিল অগ্নিগর্ভ। বিকেল ৪টায় নগরীর টাউন হল মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে একে একে জড়ো হয় হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এরপর একটি বিক্ষোভ মিছিল নগরীর চরপাড়া হয়ে বাইপাস গিয়ে অবস্থান নেয়। এতে থমকে যায় পুরো নগরী। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের একটি অংশের ওপর নগরীর মিন্টু কলেজ রোড এলাকা যৌথ হামলা চালায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ কলেজ শিক্ষার্থী রিদওয়ান হোসেন সাগর (২৪)। এ সময় অর্ধশতাধিক আন্দোলকারী আহত হয়ে ছুটতে থাকে। এরই মাঝে খবর আসে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন সাগর। আর এ ঘটনাটি সেদিন আন্দোলনকারীদের মনে নতুন করে শক্তি সঞ্চিত হয়।
অগ্নিগর্ভ সেদিনের কথা স্মরণ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক মো. আশিকুর রহমান আশিক বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই আমাদের সহযোদ্ধা সাগর শহীদ হন। সেদিন আরও অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী আহত হয়। আর সেদিন রাত থেকেই জারি হয় কারফিউ। কিন্তু কোন মৃত্যু ভয় বা বাধা আমাদের আর আটকাতে পারেনি। সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া সাগর শহীদ হওয়ার পরে ময়মনসিংহের আপামর জনতা নেমে আসে রাজপথে। এক অলৌকিক শক্তি সেদিন জাগিয়ে তুলে ছিল আমাদের। সবাই যেন শহীদ সাগর হওয়ার জন্যেই নেমে এসেছিল রাজপথে। সহযোদ্ধা হারানোর এই বেদনা যেন আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছিল। আমরা তাকে ভুলব না। আমরা তার চেতনায় বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আলী হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দিনটি ছিল শুক্রবার। নামাজ পড়েই আমরা রাজপথে নেমে আসি। ক্ষণিকের মধ্যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতায় উত্তাল হয়ে ওঠে ময়মনসিংহের রাজপথ। আমরা টাউন থেকে একটি মিছিল নিয়ে বাইপাস যাই। ওই মিছিলের একটি অংশের ওপর যৌথ হামলা চালায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ। এতে আমাদের সহযোদ্ধা সাগর গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। আহত হয় আরও অর্ধশত শিক্ষার্থী। ওই ঘটনায় আমরা মর্মাহত হলেও সেদিন সাগরের মৃত্যু আমাদের শক্তি দিয়েছিল। আমরা তার আত্মত্যাগ ভুলব না।
জানা যায়, ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া চৌরঙ্গী মোড় এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামানের ছেলে রিদওয়ান হোসেন সাগর। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সাগর ছিলেন বড়। ময়মনসিংহ ইসলামিয়া একাডেমি থেকে এসএসসি পাস করে কমার্স কলেজ থেকে পাস করে এইচএসসি। এরপর ফুলবাড়িয়া কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের শিক্ষার্থী ছিল সে। পাশাপাশি একটি কম্পিউটারের দোকানেও কাজ করত। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই নিয়মিত অংশ নিত সে। ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে সাগর হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। এরপর সন্ধ্যায় এক অপরিচিত নম্বর থেকে ফোনে জানানো হয় সাগর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। সঙ্গে সঙ্গে সাগরের বাবা ও পরিবারের স্বজনরা হাসপাতালে ছুটে যান। কিন্তু ততক্ষণে সাগর আর নেই। হাসপাতালের মেঝেতে পড়েছিল তার নিথর মরদেহ। তার বুকের বাম পাঁজরে একটি ছিদ্র ও পেটের ডান পাশে ছিল বড় গুলির ক্ষত। এরপর রাত ৮টার দিকে কয়েকজন অপরিচিত ব্যক্তি একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে সাগরের মরদেহ বাসায় পৌঁছে দেয়। পরদিন সকাল ১০টায় জানাজা শেষে বাসার পাশেই নগরীর মাদরাসা কোয়ার্টার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয় অনেকটাই নিরবে।
অপরদিকে সাগর নিহতের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা না হলেও এনিয়ে এখন পর্যন্ত থানা ও আদালতে মামলা হয়েছে ৩টি। এর মধ্যে ঘটনার দিন রাতে থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিল।
তবে দেশের পরবর্তিত প্রেক্ষাপটে আরও দুইটি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে ১টি মামলা হয়েছে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ। অপর মামলাটি করেন আন্দোলন কর্মী ফাহাদ হোসেন রিফাত। এ মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ২০০ থেকে ৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সোহরাব হোসেন বলেন, বর্তমানে সাগর নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া ৩টি মামলার মধ্যে রিফাতের মামলাটি থানায় এফআরআই হিসাবে গণ্য করে ওয়াহাব আকন্দের মামলাটি তার সঙ্গে যুক্ত করে আদালত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তবে পুলিশের মামলাটি বিতর্কিত। এসব মামলা এখন পর্যন্ত ৩১ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে এবং বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
আমান উল্লাহ আকন্দ/আরকে