৮৪ বছর বয়সেও মোটরসাইকেল চালিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেন মোল্লা মতিয়ার

৮৪ বছর বয়সেও মুখে অমায়িক হাসি নিয়ে প্রতিদিন সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন শিক্ষক মোল্লা মতিয়ার। শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিতে কখনো কোনো বিদ্যালয়ের আঙিনায় কিংবা কোনো প্রাক্তন ছাত্রের বাড়িতে। শিক্ষার আলো আর মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে এভাবেই ছুটে চলেছেন তিনি।
শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, এট জীবনের এক অবদান, এক দায়বদ্ধতা—এর বাস্তব উদাহরণ মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার কাজলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই প্রধান শিক্ষক।
১৯৬৪ সালে দ্বারিয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মোল্লা মতিয়ার রহমান। এরপর তখলপুর, চতুরিয়া, মাশালিয়া, জোকা এবং সর্বশেষ কাজলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ৩৬ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের ৩১ বছরই কেটেছে কাজলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৯৯ সালে অবসর নিলেও শিক্ষা ও সমাজসেবার প্রতি তার নিবেদন থেমে যায়নি একদিনের জন্যও।

শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান ও নিষ্ঠার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৭ সালে তিনি শ্রীপুর উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং মাগুরা জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন এবং জাতীয় পুরস্কার পান।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়—দেশপ্রেম, মানবতা ও সেবাই তার জীবনের আসল পরিচয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেন। যশোর জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে যুদ্ধ জয়ের পরে একটি বিদেশি দোনালা বন্দুকও পুরস্কার হিসেবে পান। পরে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এই শিক্ষক। শিক্ষকতা, দেশপ্রেম আর মানবসেবার এক অনন্য সংমিশ্রণ যেন মোল্লা মতিয়ার রহমানের জীবন।
গ্রামের মানুষের কাছে তিনি আজও ‘মানবতার চিকিৎসক’। কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন, কেউ বিপদে পড়লে ছুটে যান সাহায্যে। নিজের জ্ঞান ও সহানুভূতি দিয়েই হয়ে উঠেছেন অসংখ্য মানুষের ভরসার নাম।

মোল্লা মতিয়ার রহমান ১৯৫৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত টানা ৬৯ বছর ধরে নিয়মিত ডায়েরি লিখে যাচ্ছেন। ৫২ বছরের বাংলা বর্ষপঞ্জি সংরক্ষিত রয়েছে তার কাছে। রয়েছে দেশ-বিদেশের প্রায় আড়াই হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুর তারিখ ও নানা ঐতিহাসিক তথ্য। এক অর্থে, তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস।
অবসরের পরও তার শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্ববোধ অটুট। এখনো প্রতি মাসে উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে যান তিনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, সমাজে মাদক, কিশোর অপরাধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কুফল তুলে ধরেন।
আমতৈল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোল্লা ফয়জুর রহমান লাভু বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকেই বিশ্রাম খোঁজেন, কিন্তু ব্যতিক্রম প্রবীণ শিক্ষক মোল্লা মতিয়ার রহমান। তিনি স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের বিদ্যালয়ে আসেন।
আরও পড়ুন
শিক্ষক লেলিন জাফর বলেন, মতিয়ার স্যার বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, শিষ্টাচার ও দেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করেন। শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে জীবনের শিক্ষা নেয়—কেবল পড়াশোনার নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষা।
প্রাক্তন ছাত্র সামসুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ছোটবেলায় মতিয়ার স্যারের কাছে পড়েছি। স্যার খুব ভালো মানুষ। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে আমিসহ আমার পরিবারের খোঁজখবর নেন। স্যারের জন্য দোয়া করি।

স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক শাহিদুজ্জামান খসরু বলেন, মতিয়ার স্যার বৃদ্ধ বয়সে নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে পরিবারের সবার খোঁজখবর নেন। বয়স বাড়লেও স্যারের উদ্যম কমেনি। তিনি শুধু শিক্ষক নন, একজন সমাজগঠনকারী মানুষ। তার মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের কারণেই আজো গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার আলো জ্বলছে।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোল্লা মতিয়ার রহমান বলেন, যতদিন শরীরে শক্তি আছে আর মোটরসাইকেল চালাতে পারি, ততদিন আমার শিক্ষার্থীদের পাশে থাকব, খোঁজখবর নেব। বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মনটা এখনো তরুণ। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের খবর নেওয়া ওরা কেমন আছে, কি করছে সেটা জানা। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষকতা শুধু শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ নয়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাশে থাকাই একজন শিক্ষকের সত্যিকারের দায়িত্ব।
এএমকে