অবসরের পরেও যার পরামর্শে চলে বিদ্যালয়

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট শামছুন মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষক মো. তাজুল ইসলামের জীবনে শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, ছিল এক গভীর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের নাম। দীর্ঘ ৩৪ বছরের শিক্ষকতা শেষে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তবে এখনো তিনি রয়ে গেছেন শিক্ষার্থীদের স্মৃতি ও শ্রদ্ধায়। অবসরে গেলেও বিদ্যালয় পরিচালনায় এখনো নেওয়া হয় তার পরামর্শ।
১৯৫৯ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মো. তাজুল ইসলাম স্যার। তিনি ১৯৭১ সালে ইসলামনগর ফাযিল মাদরাসা থেকে ফার্স্ট ক্লাসে দাখিল পাশ করেন। পরে একই জায়গা থেকেই ১৯৭৩ সালে আলিম, ১৯৭৫ সালে ফাযিল পাশ করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে হাজী আহম্মেদ আলী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেন।
১৯৭৮ সালে রায়গঞ্জ উপজেলার হেম্মাদিয়া দাখিল মাদরাসায় শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন তিনি। মাসে ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেতন পেলেও দায়িত্বে ছিল পূর্ণতা। সেখানে ১৯৮৫ সালের মে মাস পর্যন্ত শিক্ষকতা শেষে তিনি যোগ দেন কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট শামছুন মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানেই কাটে তার জীবনের সেরা সময়, দীর্ঘ ৩৪ বছর শিক্ষকতা, সম্মান ও স্নেহে ঘেরা সময়।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নাট্যকার, কবি, বিতার্কিক ও চিত্রশিল্পী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় কুটিরচর পশ্চিমপাড়া সরকারবাড়ি জামে মসজিদ ও কুটিরচর নতুন মসজিদে ইমামতি করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত অনুরাগী এবং অন্যদেরও নামাজে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাই শিক্ষার্থীরা ও এলাকাবাসী ভালোবেসে তাকে ‘হুজুর স্যার’ বলেই ডাকতেন।
হুজুর স্যার প্রতিটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। শাসনের মধ্যেও মিশে থাকত আদর ও ভালোবাসা, সেই স্নেহেই তিনি শেখাতেন ভালো ও মন্দের পার্থক্য। ক্লাসে এসে ধর্মীয় বিষয়গুলো গল্পের ছলে, সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। নামাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিয়মিত, আজানের ধ্বনি উঠলেই সবাইকে নামাজের জন্য উৎসাহিত করতেন। পাঞ্জাবি, পায়জামা ও টুপি ছাড়া তাকে কখনো দেখা যেত না।
রাস্তায় কোনো শিক্ষার্থীকে দেখলেই তিনি খোঁজ নিতেন। জানতে চাইতেন, বাইরে কেন ঘোরাফেরা করছে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও নির্দ্বিধায় হুজুর স্যারের কাছে আসত। স্যার মনোযোগ দিয়ে সব শুনতেন এবং পরামর্শ দিতেন। কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না, বরং ধৈর্য ও মমতায় পাশে থাকতেন সবার।
আরও পড়ুন
হুজুর স্যারের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন দিবস উদযাপনের পরিকল্পনা গুণ ছিল বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। জাতীয় দিবসগুলো কীভাবে সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায়, সে বিষয়ে তিনি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। দিন শেষে দেখা যেত, তার পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনায় বিদ্যালয়ের প্রতিটি দিবস পরিপূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। আজও বিদ্যালয়ের জাতীয় দিবস উদযাপনে ব্যবহৃত হয় তার দেওয়া সেই পরামর্শ ও পরিকল্পনাগুলো, যা আজও শতভাগ কার্যকর।
তারই চার শিক্ষার্থী এখন ভদ্রঘাট শামছুন মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তাদের মধ্যে আছেন কাছিদা খাতুন রোজি, যিনি বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্য তিনজন হলেন আব্দুল মালেক, মো. শামচুল আলম ও মো. নাজমুল হোসাইন—সবাই সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
ভদ্রঘাট শামছুন মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আব্দুল মালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মো. তাজুল ইসলাম স্যারের ছাত্র ছিলাম৷ একসঙ্গে আবার শিক্ষকতা করেছি। তিনি বন্ধুসুলভ আচরণ করেন৷ চাকরি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাদান করেছেন।
বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক মো. শামচুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষক যে মানুষ গড়ার কারিগর, তাজুল স্যার তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। উনি বিভিন্ন দিবস বিদ্যালয়ে সুন্দরভাবে পালন করতেন। সেটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও বর্তমানে সেভাবেই দিবসগুলো পালন করি। কর্ম ও পারিবারিক জীবনে তার শিক্ষা ও আদর্শ কাজে লাগাই। তিনি ধৈর্যসহকারে শিক্ষা দিতেন। কর্মজীবনেও তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। অন্তর থেকে তার জন্য দোয়া করি।
হুজুর স্যারের স্মৃতিচারণ করে সহকারী প্রধান শিক্ষক কাছিদা খাতুন রোজি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্যার শুধু শিক্ষক ছিলেন না, পিতৃ ছায়ায় আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তার সঙ্গেই আবার শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছি, এটি বড় সৌভাগ্যের। তিনি ছিলেন নানা গুণের অধিকারী। স্যার ভালো ও সুস্থ থাকুক, সবসময় এই প্রত্যাশা করি।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তাজুল ইসলাম স্যার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কোনো আফসোস বা আক্ষেপ নেই। চোখে দেখে যেতে পেরেছি আমার শিক্ষার্থীরা আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক, এটিই আনন্দের। আজও যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই সম্মান পাচ্ছি। এটিই বড় পাওয়া। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় থেকে সম্মানের সঙ্গে দীর্ঘ জীবন পার করেছি। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।
একজন শিক্ষকের প্রকৃত অর্জন হয় তার শিক্ষার্থীদের সাফল্যে। মো. তাজুল ইসলামের জীবনের গল্প যেন সেই কথারই এক বাস্তব উদাহরণ।
এএমকে