১৫ বছরেও প্রতিষ্ঠা হয়নি পরিবেশ আদালত, থামছে না দূষণকারীরা

বিভাগীয় জেলা রংপুরে ১৫ বছরেও প্রতিষ্ঠা হয়নি পরিবেশ আদালত। এ কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিবেশ দূষণকারীদের বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দিন দিন দূষণের মাত্রা বেড়েই চলছে। শুকনো মৌসুমে বায়ুমান পরীক্ষায় রংপুর বিভাগ প্রায় সময় দূষিত বায়ুর শীর্ষে অবস্থান করছে। নগরায়ণের ফলে মাটি, পানি, বায়ু, শব্দদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
সচেতন মহলের দাবি অবিলম্বে সরকারের প্রতিশ্রুত পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হোক। এটি প্রতিষ্ঠা করা হলে পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলাগুলো চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পরিবর্তে সরাসরি পরিবেশ আদালতের মাধ্যমে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এতে করে দ্রুত সময়ের বিচার ও নিষ্পত্তিসহ মামলা পরিচালনায় গতি ফেরার সঙ্গে কমবে ভোগান্তি-হয়রানি।
জানা যায়, ২০১০ সালের ১৯ জুলাই পরিবেশ দূষণরোধে প্রতিটি জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের ঘোষণা দেয় সরকার। সেইসঙ্গে আইন লঙ্ঘনকারীদের ৫ বছরের সাজা ও সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘পরিবেশ আদালত আইন-২০১০’ অনুমোদন দেওয়া হয়।

এর লক্ষ্য ছিল পরিবেশ বিপর্যয়রোধে এবং পরিবেশ দূর্ষণ-সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যত্যয় ও অপরাধের আইনি কার্যক্রম পরিবেশ আদালত আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব না হওয়ায় নতুন আঙ্গিকে আইন প্রণয়ন জরুরি অনুভব করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছর পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার আইন প্রণয়ন ও পরিবেশ আদালতের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও রংপুরে পরিবেশ আদালত স্থাপন করা হয়নি। এই আদালত না থাকায় দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিছু মামলা হলেও তা পরিচালিত হচ্ছে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে। মামলার চাপে সেগুলোও সঠিক সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকার সচেতন সমাজকর্মী হাসেম আলী বলেন, দ্রুত নগরায়নে রংপুর শহরে প্রচুর শব্দ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেডিকেল মোড় পর্যন্ত নীরব এলাকা ঘোষণা করলেও তা কাগজ-কলমে রয়েছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাইক ওই সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এসব বন্ধে মোবাইল কোর্ট নয়, পরিবেশ আদালতের মাধ্যমে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কিন্তু যেখানে আদালতই নেই। সেখানে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই শব্দ দূষণ থেকে আমরা রক্ষা পাচ্ছি না।

ধাপ মেডিকেল মোড় এলাকার হামিদা আফরোজ উর্মি বলেন, আমাদের চারপাশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দেখে মনে হয়, দেশে আইন আদালত নেই। দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি পুরো এলাকার পরিবেশ মেডিকেল বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা আর শব্দ দুষণে একাকার। এটি রংপুর শহরের প্রবেশ মুখ, অথচ এত নোংরা অবস্থা যে কেউই দুর্গন্ধে হাঁপিয়ে উঠবে। রংপুরে পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় এসব নিয়ে কেউ আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ডপসের প্রধান নির্বাহী উজ্জ্বল চক্রবর্তী বলেন, পরিবেশ আদালত ছাড়া অন্য আদালতে মামলা হলে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় নিম্ন আদালত মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে যেতে বলেন। এতে একজন বিচারপ্রার্থীকে ঢাকায় যেতে হয়। সেখানে তার যাতায়াত, উকিল ম্যানেজ করাসহ নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রংপুরে পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা হলে একই আদালতে বিচারপ্রার্থীর বিচার নিশ্চিত হবে ও হয়রানি বন্ধ হবে।
মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলন-মাপার প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এএএম মুনীর চৌধুরী বলেন, রংপুর নগরীর লাইফ-লাইন শ্যামাসুন্দরী খালে দূষণ হচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা, মেডিকেল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এ খালে। এসব দূষণ করছে প্রভাবশালী, অর্থশালী ব্যক্তিরা। মোবাইল কোর্ট করে কিংবা সভা-সমাবেশ করে এটি রোধ করা কঠিন। আদালতের মাধ্যমে খাল রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া, প্রতি বছর রংপুর জেলায় অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা বাড়ছে। এর মাধ্যমে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে স্থায়ী পদক্ষেপের জন্য পরিবেশ আদালত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে অপরাধ না করেও যারা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তারাও আদালতের স্মরণাপন্ন হয়ে রক্ষা পেতে পারেন। তাই আমরা চাই দ্রুত রংপুরে পরিবেশ আদালত স্থাপন করা হোক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী এস হাসানুল বান্না বলেন, পরিবেশ, প্রকৃতি, নদ-নদী, খাল-বিল শুধু দুষণ নয় দখলও হচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে প্রভাবশালী মহল আইনের তোয়াক্কা করছে না। সংবিধান ও প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। এ কারণে রংপুরে পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটি প্রতিষ্ঠা হলে বিচারক কার্যক্রম সহজ হবে। দখলদার উচ্ছেদ, দূষণের উৎস চিহ্নিতকরণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত, সংস্কার ও পুনরুদ্ধারে পরিবেশ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক নুর আলম বলেন, রংপুরে এখনও পরিবেশ আদালত গঠন হয়নি। আমরা পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলাগুলো চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে পরিচালনা করছি। তবে পরিবেশ আদালত গঠন হলে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি কিংবা পরিবেশ দূষণরোধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে