বিলাসী জীবন ছেড়ে শিক্ষার আলো জ্বালাতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আহসান হাবিব

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ঢাকা শহরে নিজ বাড়ির আরাম-আয়েশের বিলাসী জীবন ছেড়ে চলে যান প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে জরাজীর্ণ এক বিদ্যালয়ে শুরু করেন বিনা বেতনে শিক্ষকতা। আর এভাবেই কেটে যায় ২৬ বছর, এখনো শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন ‘শিক্ষাই পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি।’—এমনই এক সাদা মনের শিক্ষক আহসান হাবীব মাসুম।
১৯৭০ সালে ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে জন্ম শিক্ষক আহসান হাবিব মাসুমের। ঢাকার মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকে প্রাথমিক, মতিঝিল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৮৫ সালে, তেজগাঁ কলেজ থেকে উচমাধ্যমিক ১৯৮৭ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় এম কম ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯৯ সালে গোয়ালপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন।
শিক্ষক আহসান হাবিব মাসুমের জীবনসংগ্রাম শুরু হয় অনেকটা কঠিন পথ পেরিয়ে। শিক্ষার্থীদের ও স্কুলের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে তিনি বিবাহ পর্যন্ত করেন নাই! তিনি যখন শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন গ্রামের শিক্ষার অবস্থা ছিল অনেকটাই করুণ। বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ, শিক্ষার্থী ছিল অল্প, আর শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না স্কুলের। অথচ ঠিক সেই সময়েই আহসান হাবিব মাসুম স্যার সিদ্ধান্ত নেন বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন, যাতে এলাকার শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।

গ্রামের মানুষের মুখে আলোর হাসি ফোটানোর স্বপ্নে তিনি নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ে চাকরি নেন। নিজের সঞ্চয় ও স্বজনদের সহায়তায় তিনি বিদ্যালয়ের ভবন সংস্কার করেন, নিজ বাড়ির একটি অংশ বিদ্যালয়ের জন্য ছেড়ে দেন এবং শিক্ষার্থীদের বইখাতা কিনে দেন। অনেক সময় নিজের হাতে রান্না করে ছাত্রদের দুপুরের খাবারও দিয়েছেন তিনি।
যদিও ১৯৯৯ সালে ২০০ টাকা টাকা বেতনে চাকরি হলেও তখন তিনি বেতন না নিয়ে পুরো টাকা স্কুলের উন্নয়নে খরচ করতেন। ২০২৪ সালে বিদ্যালয় এমপিভুক্ত হলে তাকে ৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। তবে তিনি সেই টাকাও বিদ্যালয়ের উন্নয়নে এবং দরিদ্র ও অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে খরচ করেন।
ঢাকার শাহজাহানপুরে বাবার ওয়ারাশি সূত্রে পাওয়া তিনটি বাড়ি রয়েছে তার। সেই বাড়ির ভড়ার টাকা দিয়ে চলেন তিনি। সেই টাকা দিয়েও মাঝেমধ্যে অসহায় শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেন।

আহসান হাবিব মাসুম স্যার বললেন, আমি শুধু চাই, আমার গ্রামের প্রতিটা সন্তান স্কুলে যাক। আমি ছোটবেলায় নিজে কষ্ট করে পড়েছি, জানি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কীভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি আমার সময়, শ্রম ও সামর্থ্য গ্রামের জন্য ব্যয় করব।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় মনে হয়েছে আর পারছি না। শারীরিক অসুস্থতা, আর্থিক সংকট সবই এসেছে জীবনে। তবুও পরদিন সকালে স্কুলে চলে গেছি। কারণ আমার মনে হয়েছে, আমি না গেলে ওরা হতাশ হয়ে যাবে। শিক্ষক তো শুধু পাঠদাতা নয়, সে একজন পথ দেখানো মানুষও। এই দায়িত্ব আমি আনন্দের সঙ্গেই পালন করছি।
আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ এই শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে থেকেই কেউ একদিন ভালো মানুষ হয়ে সমাজকে বদলে দেবে এই বিশ্বাসই আমাকে প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখে।—বলেন আবেগভরা কণ্ঠে আহসান হাবীব মাসুম। বিবাহের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জীবনে পিছুটান রাখতে নাই। আমি বিবাহ করলে হযতো পরিবারের মায়ায় পড়ে যেতাতাম। এখন আমার বিদ্যালয়ে বেতন ও নিজস্ব বাড়ি ভাড়া আমি শিক্ষার্থীর জন্য খরচ করতে পারি তখন আর পারতাম না।

বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেন, আহসান হাবিব মাসুম স্যার শুধু একজন শিক্ষকই নন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি গড়েছেন। তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দেওয়ান শামসুর রহমান বলেন, আমরা অনেক সময় দেখেছি আহসান হাবিব মাসুম স্যার নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে বেঞ্চ, টেবিল ঠিক করাচ্ছেন। বেতন না পেয়েও তিনি প্রতিদিন ঠিক সময়মতো আসেন। অসুস্থ থাকলেও ক্লাস মিস করেন না। তার জন্যই এই স্কুলে একটা পারিবারিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তিনি শুধু শিক্ষক নন, আমাদের সবার প্রেরণার মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, তিনি কখনো কারও কাছ থেকে কিছু চাননি, বরং তার যা ছিল তাই তিনি শিক্ষার জন্য দিয়েছেন। অনেক সময় নিজে টাকা-পয়সা খরচ করে স্কুলে বেঞ্চ-ডেস্ক কিনেছেন, খারাপ ছাউনি ঠিক করিয়েছেন। অসুস্থ শরীরেও সকালে প্রথমে স্কুলে আসেন, সবার শেষে বিদায় নেন।

তার শিক্ষা কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে এখন এলাকার অনেক তরুণও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়েছে। যারা একসময় কৃষিকাজ বা হাটবাজারে দিন কাটাত, আজ সেই পরিবারগুলোর সন্তান উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। অনেকেই আজ চাকরি করছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
তার শিক্ষার্থী চাঁপাইনবাবগন্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাকির মুন্সী বলেন, তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি একজন পথপ্রদর্শক। তার জন্যই এই এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিব বলে, স্যার আমাদের শুধু বইয়ের পড়া শেখান না, মানুষ হওয়া শেখান। তিনি বলেন, “তোমরা একদিন এই গ্রামের জন্য কিছু করবে।” আমি যখন স্কুল ফি দিতে পারিনি, তখন স্যার নিজে ফি মওকুফ করে দিয়েছেন, খাতা-কলম কিনে দিয়েছেন। তাই আমি স্যারের মতো মানুষ হতে চাই।
আরও পড়ুন
বর্তমানে বিদ্যালয়ে প্রায় ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী আজ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। কেউ কেউ আবার শিক্ষক হয়ে নিজের এলাকাতেই শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। আর এই সবকিছুর পেছনে আছে একজন মানুষের নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগ তিনি আহসান হাবিব মাসুম স্যার।
এমন সাদা মনের মানুষ আজকের সমাজে খুব কমই দেখা যায়। অর্থের মোহে যখন অনেকেই নিজ স্বার্থের পেছনে ছুটছে, তখন আহসান হাবীব মাসুমের মতো একজন মানুষ বিনা পারিশ্রমিকে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে গড়ে তুলেছেন। তার এই অবদান শুধু একটি স্কুল বা গ্রামের নয়, পুরো সমাজের জন্যই প্রেরণার।
এএমকে