চরাঞ্চলে ঘুরে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতেন শিক্ষক হারুন অর রশিদ

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, আশপাশে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন এক প্রতিকূল পরিবেশে টিন ও বাঁশের বেড়ার ছোট ঘরে শুরু করেছিলেন বিদ্যালয়। ছিল না চেয়ার-টেবিল, কিংবা প্রয়োজনীয় সামগ্রী—তবুও থেমে থাকেননি শিক্ষক হারুন অর রশিদ।
মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কখনো পুরোনো কাঠ, কখনো গাছের ডাল সংগ্রহ করে বানিয়েছেন চেয়ার-টেবিল। শিক্ষার্থী পেতে ঘুরেছেন গ্রাম থেকে গ্রাম, বাড়ি থেকে বাড়ি। বাবা-মাকে অনুরোধ করে শিশুদের বিদ্যালয়ে এনে করেছেন শিক্ষার্থী—মানুষ গড়ার কারিগর হয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে।
মানুষের সহায়তায় তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বালিয়েছেন শিক্ষার আলো। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে নিজের শ্রম, মেধা ও হৃদয়ের উষ্ণতা বিলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার সেবায়। প্রায় ২২ বছরের নিরলস সংগ্রাম ও প্রতিকূলতার পর তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি অবশেষে সরকারি স্বীকৃতি পায়। এরপরই ফিরে আসে তার মুখে তৃপ্তির হাসি। সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এক আলোকিত অধ্যায়ের সূচনা করেন এই গুণী শিক্ষক।
হারুন অর রশিদ নোয়াখালীর সদর উপজেলার আন্ডারচর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের শান্তিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২০০২ সালে তিনি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একই ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আন্ডারচর গ্রামের মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম।
নোয়াখালী সরকারি কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ থেকে পড়াশোন সম্পন্ন করেন শিক্ষক হারুন অর রশিদ। এরপর নিজের গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেন।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে শান্তিরহাট প্রি-ক্যাডেট একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন হারুন অর রশিদ। পরে ২০০২ সালে শান্তিরহাট উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাঠদান শুরু করেন। কখনো নিজ খরচে আবার কখনো অন্যের সহযোগিতায় চালিয়ে গেছেন বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে তাদের পরিবারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছেন এবং অনেক সময় তাদের পড়াশোনার দায়ভার নিজেই নিয়েছেন।
বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী প্রকৌশলী মো. মামুনুর রশিদ বলেন, আমাদের এলাকার গর্ব, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হারুনুর রশিদ স্যার—যিনি নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য শিক্ষিত মানুষ। আমরা সৌভাগ্যবান যে শৈশবে শান্তিরহাট প্রি-ক্যাডেট একাডেমির মতো একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আজ আমরা যে পথে এগিয়ে যেতে পেরেছি, তার পেছনে রয়েছে প্রিয় শিক্ষকদের ত্যাগ ও অনুপ্রেরণা। বিশেষ করে হারুনুর রশিদ স্যারকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও চিরকৃতজ্ঞতা।
বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী আফরিন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্যার শুধু শিক্ষক নন, তিনি একজন পথপ্রদর্শক। আমাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সবসময় অনুপ্রেরণা দেন। তার স্নেহ আর আন্তরিকতা আমাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আমরা স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ। স্যারের আন্তরিকতা আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে।
বিদ্যালয়ের অভিভাবক মো. আলাউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হারুন স্যার আমাদের সন্তানদের যেভাবে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবার সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছিল না, কিন্তু স্যারের অনুরোধ ও সহায়তায় এখন প্রায় সবাই নিয়মিত স্কুলে যায়।

গ্রামের প্রবীণ সমাজসেবক হাজী নুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিজের চোখে দেখেছি, কেমন কষ্ট করে হারুন স্যার স্কুলটা গড়ে তুলেছেন। একসময় যেখানে বই-খাতাও ছিল না, আজ সেখানে শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিদিন পাঠ নেয়। তিনি শুধু শিক্ষক নন, তিনি এই এলাকার এক আলোকিত মানুষ।
শিক্ষক হারুন অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার অনেক সুযোগ ছিল ভালো চাকরির জন্য এলাকার বাইরে যাওয়ার। কিন্তু আমি প্রান্তিক অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া এলাকা বেছে নিয়েছিলাম। আমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল গ্রামের প্রতিটি শিশু যেন শিক্ষার আলো পায়। মানুষ পাশে ছিল, তাই পেরেছি এগিয়ে যেতে। বিদ্যালয়টি সরকারি হওয়ায় মনে হয়—আমার দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
আরও পড়ুন
বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি মো. জিয়াউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হারুন স্যার পাঁচজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলেন। ২০২২ সালে এটি এমপিও হয়। ফলে দীর্ঘদিনের কষ্টের দিন লাঘব হয়। তবে এখনো জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে বিদ্যালয়টি। সরকার যদি এখানে একটি ভবন দিত তাহলে শিক্ষার মান আরও বৃদ্ধি পেত। সামান্য বৃষ্টি হলেই শ্রেণি কক্ষে পানি ঢুকে যায়। আমরা চাই এই মহান শিক্ষকের শেষ সময় হলেও যেন একটি ভবন হয়।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোমায়রা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষকতা মহান পেশা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা শিক্ষা, মানবতা ও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে আজও আলো ছড়াচ্ছেন। শিক্ষক হারুন অর রশিদ তাদের মধ্যে একজন। তার মতো একজন শিক্ষকই প্রমাণ করেছেন—একজন মানুষের একাগ্রতা ও ভালোবাসা পুরো একটি প্রজন্মকে বদলে দিতে পারে।
এএমকে