নেচে-গেয়ে শিশুদের স্কুলমুখী করতেন শিক্ষক ফাহমিদা খাতুন

ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে আনতে বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। কখনো ক্লাসে নেচে-গেয়ে, আবার কখনো খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের স্কুলমুখী করেছেন ফরিদপুর শহরের ভাজনডাঙ্গা গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদা খাতুন। তবে অবসরের পর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে কাটাচ্ছেন জীবনের শেষ দিনগুলো।
৬৫ বছর বয়সী ফাহমিদা খাতুন ২০২০ সালে অবসরে যান। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ওই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্কুলটি প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সরকারিকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে শিক্ষক ফাহমিদার ছিল অক্লান্ত পরিশ্রম।
তিনি শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে গেছেন বাড়ি বাড়ি, সরকারি অফিসে গিয়ে করেছেন আবেদন। এমনকি বিদ্যালয় সরকারিকরণের দাবিতে ফরিদপুর থেকে ঢাকায়ও ছুটেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভাজনডাঙ্গা গুচ্ছগ্রামে সরকারি বরাদ্দে পাওয়া ছোট্ট জায়গায় একটি আধাপাকা, প্লাস্টারবিহীন ঘরে কাটছে তার জীবন। ঘরের এক পাশে একটি স্টিলের খাট, সেখানেই ঘুমান তিনি। টিনের ছাউনি, খোলা বারান্দা আর ইটের মেঝে যেন তার জীবনের কষ্টের প্রতিচ্ছবি।
স্বামী এম এ মামুন ছিলেন শিল্পী, কিন্তু কোনো সম্পদ রেখে যাননি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মা ফাহমিদা এখন ছোট ছেলে তাজুল ইসলামের সংসারে থাকেন। তাজুল দর্জির কাজ করেন। তার সামান্য আয়ে কোনোভাবে চলে সংসার।
বয়স বেশি না হলেও শারীরিক বিভিন্ন রোগে তিনি কাহিল অবস্থা। পাশাপাশি আর্থিক দৈন্যদশায় তিনি নাস্তানাবুদ। গত এক বছর ধরে এই শিক্ষকের হৃদরোগ ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন। চোখে ঝাপসা দেখেন। চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করতে বলেছেন, কিন্তু অর্থাভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, শিক্ষার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। কোনো ছাত্র স্কুলে না এলে ছুটে গেছি তার বাড়িতে। ওদের হাসাতে ক্লাসে গান গেয়েছি, নেচেছি। এখন কেউ খোঁজ নেয় না, এটাই কষ্ট।
অবসরের পরে আছেন অর্থকষ্টে। ৩১ বছর শিক্ষকতা করলেও পেনশনের হিসাব ধরা হয়েছে মাত্র ২০১৩ সাল থেকে—যখন স্কুলটি সরকারিকরণ হয়। ফলে ১৬ লাখ টাকার পরিবর্তে পেয়েছেন মাত্র আট লাখ। এই অবিচার মেনে নিতে না পেরে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন তার ছেলে তাজুল ইসলাম।
গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চঞ্চলা রানী সরকার। তিনিও ফাহমিদার মতো স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত। তিনি এবং ফাহমিদা শিক্ষার্থী সংগ্রহ থেকে শুরু করে স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন।
আরও পড়ুন
চঞ্চলা রানী সরকার বলেন, ফাহমিদার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তাকে পেনশনের সম্পূর্ণ টাকা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তার ক্ষেত্রে একটি অমানবিক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ।
প্রধান শিক্ষক চঞ্চলা রানী সরকার আরও বলেন, শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। এই কারিগরদের যদি শেষ জীবনে এ দৈন্যদশার মধ্যে থাকতে হয় তাহলে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? তিনি বলেন, টাকার অভাবে ফাহমিদা অনেক সময় ওষুধপত্রও কিনতে পারেন না। আমরা এ স্কুলের শিক্ষকরা মাঝে মাঝে তাকে সহায়তা করি। কিন্তু আমরাই বা আর কয় টাকা বেতন পাই, কতটুকুই বা করতে পারি।
ফরিদপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বলেন, মাসে মাত্র ৮ হাজার ৩শ টাকায় এখনকার বাজারে কারও জীবন চলে না। একজন শিক্ষককে এভাবে কষ্ট পেতে দেখা সত্যিই কষ্টের।
ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব পিয়াল বলেন, যে শিক্ষিকার হাত ধরে এলাকার বহু মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখন সেই মানুষটি অবহেলিত। তার অবস্থা দেখার মতো কেউ নেই।
ফরিদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন বলেন, তিনি যদি পেনশন কম পেয়ে থাকেন, তাহলে সেটি দুঃখজনক। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। প্রাপ্য টাকা যেন তিনি পান সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এএমকে