ত্যাগেই আলোর পথিকৃৎ শিক্ষক দিলোয়ার হোসেন

১৯৯১ সালে কয়েকজন স্বপ্নবাজ তরুণ মিলে সিদ্ধান্ত নেন গ্রামের শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। অর্থের টানাপোড়েন ছিল, তবুও শিক্ষার আলো জ্বালাতে তারা পিছপা হননি। বাঁশ, কাঠ আর টিন দিয়ে তৈরি এক চালার ভেতর থেকেই জন্ম নিলো পাঁচপাই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। টিনের চালায় শুরু হওয়া সেই যাত্রায়, ত্যাগ আর নিবেদনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন সহকারী শিক্ষক দিলোয়ার হোসেন। যিনি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়তে এখনও অবিচল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার ফকিরের বাজার গ্রামের মৃত ধনু শেখ ও মৃত আয়েশা আক্তারের সন্তান দিলোয়ার হোসেন। ১৯৯১ সালে ‘চল্লিশ কাহানিয়া হাফিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে মাধ্যমিক পাস করেন দিলোয়ার তিনি। পরে ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালে নেত্রকোণা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাস করেন তিনি। তখন থেকেই কাজ শুরু করেন শিক্ষার বিস্তার নিয়ে।
জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান পাঁচপাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। সেখান থেকে আরও কয়েক কিলোমিটার দূরে কংস নদীর ফেরি ও ভাঙাচোরা রাস্তা মাড়িয়ে যখন বারহাট্টা উপজেলার ফকিরের বাজারে হাজির হলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দিলোয়ার হোসেন খুব অমায়িক মানুষ এটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। তার কথাবার্তা ও ব্যবহারে সেটির ছাপ স্পষ্ট। সময় নষ্ট না করে বসে পরলাম ওনার পরিচিত একটি ফার্মেসিতে। সরাসরি তাকে বললাম, আপনার শিক্ষক জীবনের গল্প শুনতে চাই।
দিলোয়ার হোসেন বলতে শুরু করেন, আমরা চারজন মিলে নিজ উদ্যোগে, ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করি পাঁচপাই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের একটি স্কুল। গোলাম রহমান দুলাল নামে একজন স্কুলের জন্য জমি দান করেন। আব্দুল রহিম ও জাহানারা বেগম নামে আরেকজন শিক্ষিকাকে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। তখন জমিদাতা ছাড়া, আমরা বাকি তিনজন মিলে ৪৫ হাজার টাকা একত্রিত করে বাঁশ-কাঠ ও টিন দিয়ে একটি টিনের চালা দিয়ে স্কুলটি শুরু করি। তখন গোলাম রহমান দুলালকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন পাঁচপাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, তখনকার সময়ে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া ছিল খুবই কঠিন বিষয়। আমরা শিক্ষকরা সবাই মিলে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছি। বলেছি, আপনাদের সন্তানদের আমাদের স্কুলে ভর্তি করবেন। যখন আমরা স্কুলটি শুরু করি তখন সব মিলিয়ে আমাদের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল ৮৪ জন।
১৯৯৫ সালেই আমরা তৎকালীন এমপি আবু আব্বাস সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। ওনার কাছে আমরা অনুরোধ করি আমাদের এই প্রতিষ্ঠানকে একটু রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে সহযোগিতা করার জন্য। তখন উনি আমাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন এবং ওই বছরই আমরা স্কুলের রেজিস্ট্রেশন পাই। এরপর আমাদের স্কুলে চারজন শিক্ষক থাকলেও দুইজনের বেতন আসা শুরু হয়। তখন আ. রহিম এবং আমি এই দুজন বেতন পায়নি। পরবর্তীতে রহিম ১৯৯৮ সালে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়। কিন্তু তার পরের বছরই বাকি দুইজন শিক্ষকের জন্য বেতন আসতে শুরু করে। কিন্তু ততদিনে রহিম চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছে।
১৯৯৯ সালে প্রথম ১০৫০ টাকা বেতন পাই। এটা কোনো স্কেলের আওতায় ছিল না, ভাতা হিসেবে এটি প্রদান করা হতো। এর বাইরে আর কোনো সম্মানী বা বেতনের কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের জীবনটা বলতে গেলে একরকম একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর এগিয়ে যেতে অনেক পরিশ্রম করেছি।
বিনা বেতনে চাকরির বিষয়ে পরিবার কী বলে জানতে চাইলে বলেন, পরিবার থেকে কখনো আমাকে এ বিষয়ে বাধা দেয়নি। তারা সবসময় আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে এবং বলেছে, তুমি যে কাজ করছো সেটি করে যাও। পরিবার সবসময় বলতো, জীবনে টাকা-পয়সা সব কিছু না। একটি মহান পেশায় আছো, এটাই অনেক কিছু। তোমার মাধ্যমে আর দুজন শিক্ষার আলো দেখতে পাচ্ছে, এটাই অনেক কিছু। কথাগুলো আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে। তখনকার সময়ে আমি ডিগ্রি পাস করার পর ভালো চাকরির চেষ্টা করতে পারতাম, ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু আমার মনে শিক্ষক হওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল।

৩০ বছর কষ্ট করে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। সেটি ২০১৩ সালে সরকারি হয়েছে। এটি আমার মূল তৃপ্তির জায়গা। আমার যে টার্গেট ছিল, সে টার্গেটে আমি পৌঁছাতে পেরেছি, এটাই আমার প্রাপ্তি। আমার সবচেয়ে বড় সফলতা এটাই যে আমি শিক্ষক, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং আত্মতৃপ্তির জায়গা।
ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার অনেক শিক্ষার্থী ভালো ভালো জায়গায় পড়াশোনা করছে, চাকরি করছে। তাদের মধ্যে শিক্ষক, ব্যাংক, প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা ভালো অবস্থানে রয়েছে। যেটি আমার জন্য গর্বের বিষয়।
ব্যাংক কর্মকর্তা হৃদয় মিয়া বলেন, আমাদের প্রাইমারি স্কুলের সব শিক্ষক যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিলেন। বিশেষ করে দিলোয়ার স্যার ছিলেন সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমী। আমাদের স্কুলটা মূলত কংস নদীর এ পাড়ে, আর ওনার বাড়ি নদীর ওই পাড়ে। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায়, বর্ষাকালে যাতায়াতের খুব খারাপ অবস্থা ছিল। এর মধ্যেও তিনি এসে স্কুলে এসে আমাদের ক্লাস করিয়েছেন।
তিনি বলেন, ওনার ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবহার খুবই ভালো ছিল। পাশাপাশি তার বোঝানোর দক্ষতাও ভালো ছিল। স্যারের সবচেয়ে যে বড় গুণ হলো, উনি সবসময় যোগাযোগ রেখেছেন আমাদের সঙ্গে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও উনি আমাদের পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। ছোট থেকে দেখে আসছি, উনি অনেক ডেডিকেটেড একজন মানুষ। ওনার পড়ানোর ধরনটা অনন্য ছিল, আমরা সহজেই বুঝতে পারতাম। ছাত্রদের কাছে উনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
আরও পড়ুন
দিলোয়ার হোসেনের ছাত্র শাহারিয়ার হাসান কল্লোল বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে ওনার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার মান খুব একটা ভালো ছিল না। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসত না সে সময়। তখন তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়ে বলতেন যেন বাচ্চাদের স্কুলে পাঠায়।
পাঁচপাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুলটির প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যে কজন সদস্য ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন দিলোয়ার স্যার। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই শ্রম-ঘাম দিয়েছেন অপরিসীম। তিনি চৌকস একজন শিক্ষক। সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। শিক্ষক হিসেবে শ্রেণি কক্ষে তিনি খুবই আন্তরিক। উনি প্রায় সময় আমাদেরও সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি স্কুলের সার্বিক তত্ত্বাবধানের বিষয়টি তার ওপরেই ন্যস্ত। শুধু স্কুলের বিষয়ে না, অন্যান্য বিষয়েও যখন সমস্যার সম্মুখীন হই তখনও ওনার শরণাপন্ন হলে অভিনব পন্থায় তিনি সেটা সমাধান করে দেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, উনি যে গ্রামের সন্তান সে গ্রামে তার যতটুক পরিচিতি রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিচিতি রয়েছে তার স্কুল এলাকায়। ওনার মতো একজন শিক্ষক পেয়ে আমি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে খুবই গর্বিত এবং আনন্দিত।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ শহীদুল আজম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই শিক্ষককে না চিনলেও, আমরা সব সময় এরকম শিক্ষকদের আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে থাকি। আমরা সব সময় ত্যাগীদের অগ্রাধিকার এবং সম্মান দিতে চেষ্টা করি যেন সমাজে শিক্ষার বিস্তার ও মান আরও বাড়ে। আমরা সব সময় এমন শিক্ষকদের খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি। পাশাপাশি কেউ যদি কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, আমরা সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করি। শিক্ষা অফিস সবসময় শিক্ষকদের পাশে আছে।
আজ দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। বিদ্যালটি সরকারি হয়েছে, শিক্ষক বদলেছে, সময় বদলেছে। কিন্তু একজন মানুষ এখনো অবিচল দাঁড়িয়ে, সেই শিক্ষার দীপশিখা হাতে। তিনি সহকারী শিক্ষক দিলোয়ার হোসেন।
এএমকে