৭২ বছর ধরে সমেশপুরে সবজির চারা উৎপাদন, খ্যাতি দেশজুড়ে

একটি গ্রামের সব আবাদি জমিতে শুধু শাকসবজির চারা। সর্বোচ্চ ২০ দিন বয়সী এসব সবজির চারা কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন ক্রেতা। মূলত চাষিরাই এসব চারার ক্রেতা। শীতকালীন সব শাকসবজির চারার উৎপাদন হয় এখানে। গ্রামের যতদূর চোখ যায় শুধু চারাতে আচ্ছন্ন চারদিক। প্রতিবছর প্রায় ৮-১০ কোটি টাকার চারা বিক্রি করেন উদ্যোক্তারা।
গ্রামটির নাম সমেশপুর। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘চারার গ্রাম’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে গ্রামটি। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই উদ্যোক্তা। জীবিকা নির্বাহ করতে আবাদি জমিগুলোতে শীতকালীন বিভিন্ন শাক ও সবজির চারা উৎপাদন করেন তারা। স্বাবলম্বীও হচ্ছেন, কৃষি পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি চারা উৎপাদন করেও লাভবান হচ্ছেন তারা।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নে অবস্থান সমেশপুর গ্রামের। কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই সাহেব বাজার নামক স্থান থেকে ডান দিকে কয়েক মিনিটের পথ। এই গ্রামে বিভিন্ন জেলার সবজি চাষিদের নিত্য আনাগোনা। এসব চাষিরা এখান থেকে চারা কিনে নিয়ে জমিতে লাগিয়ে শাকসবজি উৎপাদন করেন।

এখানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ, শিম, লাউ, কুমড়া, ব্রকলিসহ অন্তত ২৩ ধরনের সবজির চারা উৎপাদন হয়। চারা বিক্রি শেষে আবার নতুন করে বীজ বপনের অপেক্ষায় থাকেন উৎপাদনকারীরা।
শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকালে ওই গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে কৃষকদের ব্যস্ততা দেখা গেছে চোখে পড়ার মতো। কেউ ক্রেতাদের সঙ্গে চারার দর কষাকষি করছেন, কেউ চারায় পানি ছিটাচ্ছেন, কেউ আবার চারা তুলে গুনে গুনে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পুরো মাঠজুড়ে এক অন্যরকমের ব্যস্ততা। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত চাষিরা ভিড় করছেন চারার জন্য।
উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন থেকে ৭২ বছর আগে এই গ্রামে খোরশেদ আলম নামের এক ব্যক্তি সবজির চারা উৎপাদন শুরু করেন। তার এই চারা উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে রূপ নেয় ধীরে ধীরে। গ্রামের মানুষ তার এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে সবজির চারা উৎপাদনে নামতে থাকেন। এভাবেই কালের পরিক্রমায় পুরো সমেশপুরে আবাদি জমির মালিকরা চারা উৎপাদনে মনযোগী হন।

চারা উৎপাদনে রয়েছে বিভিন্ন ধাপ। একটি আবাদি জমিতে মাটিকে প্রথমে উর্বর করা হয়। প্রতিটি জমিতে কয়েকটি উঁচু অংশে খণ্ডিত করা হয়। খণ্ডিত এই উঁচু অংশকে বিট বলেন উৎপাদনকারীরা। প্রতিটি বিটকে বীজতলায় তৈরি করে তাতে বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত একটি বিট লম্বায় ১২ ফুট এবং ৪ ফুট প্রশস্ত করা হয়। একেকটি বিটে ৩-৪ হাজার বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। বীজ ছিটানের ৩-৪ দিনের মধ্যেই চারা গজায়। গজানো এসব চারা ২০ দিনের মধ্যে বিক্রির উপযুক্ত হয়। এর ফাঁকে কিছু প্রয়োজনীয় সার-কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। বিটের ওপরে দুই স্তরের পর্দায় ঢেকে রাখা হয়৷ পর্দাগুলো সাধারণত পিলিথিনের হয়ে থাকে। এই পর্দা টানানোর জন্য বিটের ওপর বাঁশের তৈরি ছোট মাচার মতো ব্যবস্থা করা হয়। বিটের চারপাশে খুঁটিতে আটকানো থাকে পলিথিনের এই নিরাপত্তা। বীজ থেকে চারা গজানোর পর সবার ওপরের ভারী কালো পলিথিন সরিয়ে দেওয়া হয়। চারা কিছুটা বড় হলে নিচের সাদা পলিথিনের পর্দাও সরিয়ে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে উৎপাদনকারীদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। বৃষ্টি কিংবা ঝড়ের সংকেত পেলেই আবার ঢেকে দেওয়া হয় যাতে করে চারার কোনো ক্ষতি না হয়।
১৫-২০ দিন বয়সী যে কোনো সবজির চারা বিক্রি হয় পিস হিসেবে। একপিস চারা তার আকার, আকৃতি ও ফলন ভেদে ১ টাকা, ১ টাকা ২০ পয়সা, দেড় টাকা, ২ টাকা এবং সর্বোচ্চ আড়াই টাকায় বিক্রি হয়। চাষিরা এসব চারা কিনে জমিতে বপন করে ফসল উৎপাদন করেন। বীজ বপনের ২০ দিনের মাথায় চারা বিক্রি হয়ে বিট খালি হয়ে গেলে নতুন করে বীজ বপন করা হয়। এভাবে প্রতিবছর ভাদ্র মাস থেকে শুরু হয়ে আশ্বিন, কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ—এই চারমাস ধরে চারার এই কর্মযজ্ঞ চলে সমেশপুরে। চারার মৌসুম শেষ হলে এসব জমিতে টমেটো, আলু, বেগুনসহ বিভিন্ন রবি ফসল উৎপাদন করেন উদ্যোক্তারা। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় বীজের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় লাভ কিছুটা কম হচ্ছে বলে দাবি এসব চারা উৎপাদনকারীর।
কৃষি উদ্যোক্তা মো. রফিক মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৭ দশক ধরে আমাদের এখানে চারার উৎপাদন চলছে। গ্রামটির নামই হয়ে গেছে চারার গ্রাম। আমি ৪০ শতক জমিতে চারা উৎপাদন করছি। গেল বছরের তুলনায় বীজের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় লাভ কিছুটা কম হচ্ছে।

আনোয়ার হোসেন নামের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চারা উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা। আপনি ধরেন ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করছেন। এই বিনিয়োগটা লাভসহ ২০ দিন থেকে ১ মাসের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছেন।
জামশেদ আলী নামের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের উৎপাদিত চারা দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে চাষিরা আমাদের গ্রামে আসেন। এই গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
এখানকার উৎপাদন সবজির চারা চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ফেনী, সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর দিনাজপুরসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে যাচ্ছে। তবে দূরের এসব ক্রেতাদের এখন আর স্বশরীরে না এলেও হয়। ফোন করে কোন সবজির চারা কত পিস পাঠাতে হবে তা বলে দিলেই পার্সেল আকারে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্রেতারা চারাগুলো পেয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন।
জুলফে আলী নামের উৎপাদনকারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে এই ব্যবসাটি করছি। প্রতি সিজনেই ৪-৫ লাখ টাকা আয় করি। তবে এবার একটু লাভ কম হবে। অনেক চারা তুলে ফেলে দিতে হয়েছে। এবার বৃষ্টি হয়েছে অনেক।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সমেশপুরে ১২ একর জমিতে প্রায় ২৩ প্রজাতির সবজির চারার উৎপাদন হয়। এসব চারা বিক্রি করে স্বচ্ছলতা পাচ্ছেন উৎপাদনকারীরা।
বুড়িচং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরিণা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর এখানে ২০ একর জমিতে চারা উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর ১২ একর জমিতে উৎপাদন হয়েছে। এ বছর কমে যাওয়ার কারণ হলো অসময়ে এবার প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাতের ফলে এখানে জলাবদ্ধতার সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। উপজেলা কৃষি অফিস সবসময় কৃষি উদ্যোক্তাদের পাশে আছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা কাজ করেছি। আশা করছি আগামী বছর এখানকার চারা উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে।
কুমিল্লা সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চারা উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা। সমেশপুরের চারা দেশের বিভিন্ন জেলাতে যায়। কৃষকরা যেন আরও ব্যাপকভাবে চারা উৎপাদন করতে পারেন সেজন্য কৃষি অফিস তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
আরিফ আজগর/এএমকে