১৮ বছরেও শুকায়নি সিডরের ক্ষত

সিডরের ১৮ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু বাগেরহাটের শরণখোলা–মোরেলগঞ্জের মানুষের চোখে আজও সেই রাতের আতঙ্ক একই রকম তাজা। ‘ঘূর্ণিঝড়’ শব্দটি শুনলেই তারা এখনো কেঁপে ওঠে। তার ওপর নতুন করে যোগ হয়েছে বেরিবাঁধ ধস, নদী ভাঙন আর প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটাই আকুতি—‘বাঁধ টেকসই না হলে আমরা কোথায় গিয়ে বাঁচব?’
শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালীর মো. দেলোয়ার হোসেন সেদিনের কথা বলতে গিয়েও থমকে যান। কথার ফাঁকে চোখ ভিজে ওঠে তার। তিনি বলেন, ‘সিডরের আগে সরকার কোনো সংকেত দেয়নি। আমরা ভাবছিলাম কিছু হবে না। তখন আমার ছেলে ছিল পাঁচ বছরের, মেয়ে চার মাসের। হঠাৎ এমন স্রোত এল—বাড়ির ভেতরেই পানি ঢুকে সব উলটপালট। পানির বেগে প্রথমে ছেলেটাকে নিয়ে গেল। তারপর মেয়েটাকেও মায়ের কোলে থেকে ছিনিয়ে নিলো। আমরা কত চেষ্টা করেছি, কিছুই করতে পারলাম না। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ঘরবাড়ি কিছুই রইল না। সে দিনটা আজও ভুলতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘রাতে ঘুমাই, আবার লাফ দিয়ে উঠে যাই—ওই দিনের কথা মনে পড়ে। মনে হয় আবার পানি আসবে। মোটামুটি একটু স্বাভাবিক হচ্ছিলাম, এর মাঝে গত ২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় রেমাল আবার সবকিছু শেষ করে দেয়।’

এখন তারা বেরিবাঁধের ওপরে ছোট্ট একটা ঘর তুলে বাস করছেন। কিন্তু সেই বাঁধের অবস্থাও ভয়ংকর। বাঁধে বড় বড় ফাটল। সিমেন্ট ব্লক পড়ে গেছে নদীতে। দেলোয়ার বলেন, ‘আমরা চাই নদীকে ঠিকভাবে শাসন করা হোক। তাহলে পানির চাপ কমবে, ভাঙনও কমবে। আর যদি খাবার পানির ব্যবস্থা করে দেয় সরকার—তাহলে এখানে মানুষ থাকা সম্ভব।’
দক্ষিণখালী ইউনিয়নের শাহজাহান মোল্লা আজও নিজের পরিবার হারানোর কথা মনে করলে স্থির থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘সিডর থেকে বাঁচতে ট্রলারে উঠেছিলাম। ট্রলার উল্টে গেল। মা-বাবা, ছোট বোন, সেজো ভাই, বড় ফুফু আমাদের ১৯ জন সদস্য মারা গেল সেদিন। আজও মনে পড়লে ঘুম হয় না। আল্লাহ যেন এমন দিন আর পৃথিবীতে না আনেন।’
তিনি বলেন, ‘এখনো আমরা আতঙ্কে থাকি। যে ১৫ কিলোমিটার বেরিবাঁধ দিয়েছে, তা অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। যদি বাঁধটা শক্ত করে দিতো, তাহলে অন্তত একটু নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারতাম।’

সাউথখালী গ্রামের জাকির মুন্সি বলেন, ‘সিডরের রাতে আমার ঘরের টিন উড়ে গেছিল। আমরা গাছ ধরে বেঁচেছিলাম। এরপর রেমাল এসে আবার সব ভাসিয়ে দেয়। এত বছর ধরে যে ভাঙন দেখি, মনে হয় নদীটা আমাদের পিছু নিয়েছে। বাঁধটা ঠিকমতো থাকলে এত কষ্ট হতো না। রাতে শুতে গেলেই ভয় লাগে, আবার যেন পানি এসে সব নিয়ে না যায়।’
বগি গ্রামের আলামিন খান বলেন, ‘বাঁধের ফাটল দিনে দিনেই বড় হচ্ছে। আমরা নিজেরাই বালুর বস্তা ফেলে আটকানোর চেষ্টা করি। সরকার যদি আগে থেকেই নজর দিতো, এখন এই পরিস্থিতি হতো না। ঘূর্ণিঝড় এলেই মনে হয়—বাঁচব তো?’
সাউথখালী গ্রামের ওমর মুন্সী বলেন, ‘শিশুরা স্কুলে মন বসাতে পারে না। ঝড়ের শব্দ বা আকাশ কালো হলেই তারা ভয় পায়। অভিভাবকরা অনেকেই বলেন, “বাঁধ ভাঙলে প্রথমেই আমাদের স্কুলটাই ডুবে যাবে।” তাই একটা টেকসই বেরিবাঁধ শুধু ঘরবাড়ি নয়, শিক্ষার ভবিষ্যতও বাঁচাবে।’

১৯৮৫ থেকে ২০২৫ চার দশক ধরে উপকূলবাসীর জীবনে ঘূর্ণিঝড় মানেই আতঙ্ক। কিন্তু ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডর যে ক্ষত রেখে গেছে, তা ১৮ বছরেও শুকায়নি। ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। গাছ, ঘরবাড়ি, রাস্তা সব ভেসে যায় মুহূর্তে। সেই ভয়ংকর স্মৃতি এখনো মানুষের মনে পাথরের মতো চাপা হয়ে আছে। এর ওপর আবার বেরিবাঁধ ভাঙনের নতুন সমস্যা।
শরণখোলার বগী, গাবতলা, দক্ষিণখালী, আর মোরেলগঞ্জের আমতলা ও ফাসিয়াতলা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে—বাঁধের লম্বা ফাটল, কোথাও ধস, কোথাও সরে গিয়ে নদীতে পড়েছে ব্লক। যে বাঁধ মানুষের জীবন বাঁচানোর কথা, সেটাই এখন আতঙ্কের আরেক নাম।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিষয়টা একটু খোলাসা করে বললেন। তার ভাষায়, ‘শরণখোলার বেড়িবাঁধগুলো হঠাৎ টানা বৃষ্টিতে নরম হয়ে ভেঙে পড়েছে, আর নদীভাঙন তো আছেই, এক জায়গায় নয়, বহু স্থানে।
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো মেরামতের জন্য ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। একটি প্যাকেজের কাজ মাঠে নেমেছে, আর বাকিগুলো ধাপে ধাপে শুরু হবে।
২০০৭ সালের সিডর শুধু বাগেরহাটেই কেড়ে নেয় ৯০৮ জনের প্রাণ। শরণখোলা, মোরেলগঞ্জে তছনছ হয়ে যায় দেড় লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ ও ফসল। সেই সময় থেকে উপকূলবাসীর একমাত্র দাবি একটি শক্তিশালী, টেকসই বেরিবাঁধ। ১৮ বছর পর সেই দাবি পূরণ হলেও এখন আবার সেই বাঁধই ভাঙনের মুখে।
শেখ আবু তালেব/এএমকে