ধানের শীষের উত্তরসূরি নায়াব, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আজাদ-তাওয়াব

ফরিদপুর সদর উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-৩ সংসদীয় আসন গঠিত। জেলা সদর হিসেবে এ আসনটি ফরিদপুরের অন্য তিন আসনের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ আসন থেকে নির্বাচিত সদস্য জেলার রাজনীতিতে মূল নিয়ামক শক্তি তথা ক্ষমতার ভারকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হন।
আসন্ন ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ফরিদপুর-৩ আসনটি নানা সমীকরণের কারণে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই আসনে তিনটি শক্তি সমানতালে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয়েছেন যথাক্রমে চৌধুরী নায়াব ইউসুফ (৫৩) এবং আবদুত তাওয়াব (৭০)। এর পাশাপাশি নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ী নেতা ও সাবেক এমপি এ কে আজাদ (৬৫)।
ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা আর স্বতন্ত্র প্রতীকের এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফরিদপুরের নির্বাচনী মাঠে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। একদিকে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বিএনপির প্রার্থী নায়াব ইউসুফ, অন্যদিকে ব্যবসা ও উন্নয়ননির্ভর জনপ্রিয়তায় উজ্জ্বল স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ। এই দুই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে কখনো নীরবে আবার কখনো সরবে কৌশলে ভোটারের মন জয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী আবদুত তাওয়াব।
ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে ধানের শীষে নায়াব ইউসুফ
এই আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী চৌধুরী নায়াব ইউসুফ কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি একজন তরুণ, মার্জিত ও শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী ময়েজ মঞ্জিলের সদস্য, বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও এই আসনের পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের বড় মেয়ে। তার দাদা চৌধুরী মো. ইউসুফ আলী ওরফে মোহন মিয়াও ছিলেন সক্রিয় রাজনীতিক ও সমাজসেবক।
নায়াব ইউসুফ বি.কম পাস করা একজন রাজনীতিক, যিনি বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফরিদপুরের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চান পরিবারের ঐতিহ্য। মনোনয়ন পাওয়ার আগে থেকেই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সদর উপজেলার অলি-গলিতে। প্রাথমিকভাবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই তিনি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাইছেন।
নর্থচ্যানেল, কবিরপুর, ধলার মোড়, কানাইপুর, অম্বিকাপুর ও আলীপুর এলাকায় তিনি প্রতিদিনই উঠান বৈঠক করছেন। শহর এলাকায় ড্রেনেজ, যানজট ও পানি নিষ্কাশন সমস্যা এবং চরাঞ্চলে নদীভাঙন ও কৃষি সংকট সমাধানের অঙ্গীকার করছেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন- নির্বাচিত হলে নদীভাঙন রোধে কাজ করবেন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ফরিদপুরকে একটি মডেল জেলায় রূপান্তরিত করবেন।

নায়াব ইউসুফ বলেন, আমাদের পরিবারের শেকড় এই ফরিদপুরের মাটিতে। আমার বাবা ও দাদা জনগণের সেবায় ছিলেন নিবেদিত। আমি তাদের কাছ থেকেই শিখেছি— ক্ষমতা মানে দায়িত্ব, ভোগ নয়। আমি মাটির মানুষ, তাই মাটির মানুষের দুঃখ বুঝি।
কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে চান এ কে আজাদ
২০০৮ সাল থেকে ফরিদপুর-৩ আসন ছিল আওয়ামী লীগের অঘোষিত দুর্গ। এই আসনে সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের দীর্ঘদিনের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলীয় বিভাজন ও মনোনয়ন-অসন্তোষে সেই দুর্গে ফাটল ধরে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক মনোনয়ন পেলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীর বিরোধিতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং এ কে আজাদের সাংগঠনিক তৎপরতায় দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়ী হন ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ।
এ কে আজাদ বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগ্রুপ হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের মালিক, নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলি মহল্লার বাসিন্দা এই উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়নে স্নাতকোত্তর পাস। তার মালিকানাধীন হা-মীম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফরিদপুর সদরের বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ করেন। প্রত্যক্ষভাবে এসব পরিবার তার ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ২০২৪ সালে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সাত মাসের মধ্যেই জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটে।

নির্বাচন সামনে রেখে এ কে আজাদ এখন নিয়মিত মাঠে রয়েছেন। চরাঞ্চল, শহর ও গ্রাম— সবখানেই উঠান বৈঠক করছেন, যোগাযোগ রাখছেন স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে। কর্মসংস্থান নিশ্চিতে স্থাপন করেছেন প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তার পরিবারের সদস্যরাও স্থানীয়ভাবে গরিব-অসহায় মানুষকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন তার পক্ষে।
এ বিষয়ে কথা বলতে এ কে আজাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে সম্প্রতি এ কে আজাদের পক্ষে সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের পরমানন্দপুর বাজারে জনসংযোগ ও অনুদান প্রদান করেন হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব হোসেন ও পরিচালক মো. বেলাল হোসেন।
ওই সময় চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব হোসেন এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ফরিদপুর-৩ আসনের জনসাধারণের উদ্দেশে বলেন, এ কে আজাদ এ জনপদকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও স্বাবলম্বী শহরে রুপান্তর করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন। আপনারা জানেন আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফরিদপুর সদর আসনের জনগণ চাকরি করছে। আগামীতে এ শহরে একটি মানুষও যেন কর্মহীন না থাকে।
নীরব-সরব কৌশলে জামায়াতের আবদুত তাওয়াব
ফরিদপুর-৩ আসনে জামায়াতে ইসলামীও পিছিয়ে নেই। দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিসিএস শিক্ষা কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য আবদুত তাওয়াব। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস। ফরিদপুর সদরের চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের হাফেজডাঙ্গি এলাকার বাসিন্দা আবদুত তাওয়াব বর্তমানে শহরের গুহলক্ষ্মীপুর মহল্লায় বসবাস করছেন।
আবদুত তাওয়াব মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও ওয়ার্ডভিত্তিক উঠান বৈঠকের মাধ্যমে দলের তৃণমূলকে সক্রিয় করে তুলেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের একটি স্থায়ী ভোটব্যাংক রয়েছে, যা এবারও তাদের আশাবাদী করছে।
দলটির দুই কর্মী বলেন, আমরা এ কে আজাদ ও বিএনপির ভোট ব্যাংকের ফাঁক গলে কিছু ভোট নিতে পারলে ভালো অবস্থানে থাকতে পারব।
ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার পাশাপাশি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় আবদুত তাওয়াবের সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তার সমর্থকরা লিফলেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সদর উপজেলার পথপ্রান্তরে।

আবদুত তাওয়াব বলেন, আমরা মাদকমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত ফরিদপুর গড়তে চাই। চারটি ‘না’ আমাদের অঙ্গীকার— চাঁদা নেব না, নিতে দেব না, দুর্নীতি করব না, করতে দেব না। জনগণ যদি আস্থা রাখে, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে স্বপ্নের ফরিদপুর গড়ে তুলব।
ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন ভোটাররা
বর্তমানে ফরিদপুর-৩ আসনের রাজনৈতিক মঞ্চে তিন প্রার্থীই শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। ভোটারদের ধারণা, এই তিন প্রার্থী শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।
ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরের বাসিন্দা, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তোহাবুল ইসলাম (২২) বলেন, এই আসনে প্রার্থী তিনজনেরই নিজস্ব ভোটব্যাংক ও জনপ্রিয়তা আছে। চরাঞ্চল, শহর ও শিক্ষিত ভোটার শ্রেণির পছন্দ নির্ধারণ করবে শেষ ফলাফল।
শহরের কমলাপুর মহল্লার বাসিন্দা শেখ রানা বলেন, এই তিন নেতা নির্বাচনী মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে ফরিদপুর সদরের সর্বস্তরের মানুষ ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখতে পাবে। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরিবেশ থাকলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবে।
শহরের গোয়ালচামট মহল্লার বাসিন্দা শ্যামল বিশ্বাস বলেন, এ আসনে জাতীয় নির্বাচন বরাবরই দ্বিমুখী হয়। অর্থাৎ দুইজন প্রার্থীর মধ্যেই ভোটারদের পছন্দ- অপছন্দ নির্ভর করে। এবার হয়তো নির্বাচন ত্রিমুখীই হবে।
শহরের টেপাখোলা মহল্লার বাসিন্দা মো. শহীদ উল্লাহ (৭১) বলেন, আমাদের দেশের মানুষ ভোট দিতে ভুল করে না। যে যতই হিসাব কষুক, সময় বলে দেবে কে হবে জয়ী। তবে বর্তমানে নির্বাচনের পরিবেশ পাল্টে গেছে। ভোটে পেশীশক্তি, অর্থশক্তির একটা খেলা চলে। সেই খেলাই অনেক সময় জয় নির্ধারণ করে দেয়। সেই হিসেবে অর্থের জোরে যে এগিয়ে থাকবে, শেষ হাসি তিনিই হাসবেন— এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আরএআর