পদ্মা সেতুর প্রভাবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে যাত্রী সংকট

পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের ফেরি ও লঞ্চঘাট এখন অচলপ্রায়। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় এসব ঘাটে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগে সময় ও ভোগান্তি কমে আসে। কিন্তু এই উন্নয়নের আড়ালে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি ও লঞ্চঘাটের চারপাশে জীবিকানির্ভর হাজারো মানুষের জীবন প্রায় থমকে যায়।
এক সময় দেশের প্রধান এই নৌপথ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রাণকেন্দ্র ছিল। দৌলতদিয়া ঘাটে দিন-রাত ৫-৭ কিলোমিটার দীর্ঘ যানবাহনের সারি লেগে থাকত। মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছিল স্থায়ী-অস্থায়ী হোটেল-রেস্তোরাঁ, আবাসিক হোটেল, দোকানপাট ও হকারের ভিড়। প্রতিদিন শত শত রিকশাচালক যাত্রী পরিবহনে ব্যস্ত থাকতেন, আর সহস্রাধিক হকার জীবিকা নির্বাহ করতেন লঞ্চ ও ফেরিঘাটকে কেন্দ্র করে। ট্রাকচালকদের আড্ডা, যানবাহনের কোলাহল ও নদী পারাপারের তাড়া-সব মিলিয়ে তখন ঘাট ছিল দেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র।
কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হওয়ার পর সবকিছু মুহূর্তেই বদলে যায়। আগে ৭টি ফেরিঘাট দিয়ে দিনে ১৮-২০টি ছোট-বড় ফেরি চলত। উভয় ঘাট মিলে ২৪ ঘণ্টায় ১০ হাজারের মতো বিভিন্ন যানবাহন পারাপার হতো। এখন ফেরিগুলো বেশিরভাগ সময় অলস পড়ে থাকে। মাত্র ৭-৮টি ফেরি দিয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট সচল রাখা হচ্ছে। বর্তমানে দিনে সর্বোচ্চ ৪ হাজার যানবাহন নদী পারাপার হয়।
লঞ্চঘাটের চিত্র আরও করুণ। আগের সেই চিরচেনা কোলাহল নেই। যাত্রীদের ভিড় নেই, লাল পোশাক পরিহিত কুলিদের দেখা মেলে না, হকারদের আনাগোনা নেই। ঘাটের চারপাশে আর ভাসমান দোকানের পসরা দেখা যায় না। এক সময় দিনে ১২-১৫ হাজার যাত্রী লঞ্চে পারাপার হতো, পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল শুরুর পর এখন উভয় ঘাট মিলে সর্বোচ্চ ৩ হাজার যাত্রী পারাপার হয়।

এই পরিবর্তনের ফলে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটের দুই পাশের ব্যবসায়িক জৌলুশ হারিয়েছে। লঞ্চ ও ফেরিঘাটকেন্দ্রিক বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, আবাসিক হোটেলসহ স্থায়ী ব্যবসায়ীরা লোকসানের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। শত শত দোকান এখন খালি পড়ে আছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আজিবর মণ্ডল বলেন, আগে দিনে-রাতে লাখ টাকার বিক্রি হতো, এখন খরচই উঠছে না। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ করলেও তাদের কর্মহীন করে ফেলেছে।
চা বিক্রেতা ইয়াকুব আলী বলেন, আগে দিনে হাজার কাপ চা বিক্রি হতো, এখন ১০০ কাপও হয় না। বাধ্য হয়ে দোকান বন্ধের কথা ভাবছেন তিনি।
দৌলতদিয়ার বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন বলেন, নতুন প্রজন্ম হয়তো কখনো কল্পনাও করতে পারবে না দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটের আগের ব্যস্ততা ও কোলাহল। তার ভাষায়, এটি শুধু যাতায়াতের পথ ছিল না, বরং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল।
প্রায় ২০ বছর ধরে দৌলতদিয়া ঘাটে কর্মরত সাদেকুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুতে রেল চালুর পর ফেরিঘাট আরও অচল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, লঞ্চঘাটের পুরোনো কাঠামোও ভেঙে যাচ্ছে। এক সময়কার জাঁকজমক এখন পরিণত হয়েছে নির্জনতায়।
এ যেন উন্নয়নের ভিন্ন চিত্র সময় বাঁচলেও হারিয়ে গেছে হাজারো মানুষের জীবিকা। এক সময়ের প্রাণবন্ত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি ও লঞ্চঘাট এখন কেবল ইতিহাসের অংশ, স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছে তাদের জৌলুশময় দিনগুলো।
দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের ম্যানেজার মো. নুরুল আনোয়ার মিলন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার যাত্রী লঞ্চে পারাপার হতো। তখন ২২টি লঞ্চ দিয়েও হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু এখন বেশিরভাগ লঞ্চই দিনের পর দিন অলস পড়ে থাকে। সেতু চালুর পর কিছুটা যাত্রী মিললেও রেল চলাচল শুরু হওয়ার পর ঘাট একেবারে যাত্রীশূন্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সর্বোচ্চ এক হাজার থেকে দেড় হাজার যাত্রী পারাপার হয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিন জানান, সেতু চালুর আগে ২৪ ঘণ্টায় শুধু দৌলতদিয়া প্রান্ত দিয়েই ৫ হাজারের বেশি যানবাহন পারাপার হতো। তখন ঘাট এলাকায় সবসময়ই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকত।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সব ফেরি সচল থাকলেও ঘাটে গাড়ি না থাকায় ফেরিকেই অপেক্ষা করতে হয়। ফলে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে আর আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য নেই।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/এআরবি