কুড়িগ্রাম-২ আসনে সক্রিয় বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি

জাতীয় পার্টির অপ্রতিরোধ্য দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল কুড়িগ্রাম-২ আসন। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে আসনটি দখলে নিতে মরিয়া বিএনপি। অতীতে প্রয়াত জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ থেকে শুরু করে দলের একাধিক প্রার্থী এ আসনে জয়ী হয়েছেন। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভাবনীয় বিজয়ের পর জাপার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়। এবার আসনটি দখলে নিতে মাঠে নেমেছে বিএনপি। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াছিন আলী সরকার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী অধ্যক্ষ মাওলানা নূর বখত, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রার্থী দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ড. আতিক মুজাহিদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির নেতাকর্মীরা মিছিল, মিটিং ও জনসভাসহ গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেন দম ফেলার ফুরসৎ নেই প্রার্থীদের।
স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জাতীয় পার্টির অপ্রতিরোধ্য দুর্গ বিএনপি ভাঙতে পারবে। তবে ইসলামি দলগুলো জোট করলে সে আশায় গুঁড়ে-বালি। তার ওপর যদি সেই জোটে এনসিপির মতো নতুন দল যুক্ত হয় তবে বিএনপির পক্ষে এ আসনে ভালো করা কঠিন হবে।
জাপার দুর্গ ভেঙে বিএনপিকে জয় উপহার দিতে চান কায়কোবাদ
কুড়িগ্রাম-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ। তিনি ১৯৭০ সালের ২৯ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম পৌরসভার পুরাতন স্টেশন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম আব্দুল কুদ্দুস শিক্ষক এবং আইনজীবী পেশায় ছিলেন, মা কুড়িগ্রাম ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা সখিনা খাতুন। এই দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান সোহেল হোসাইন কায়কোবাদ। তিনি ১৯৮৭ সালে মাধ্যমিক, ১৯৮৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং এরপরে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে পড়াশুনা শেষ করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৬ সালে সক্রিয়ভাবে ছাত্রদলের রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৮৮ সালে ছাত্রদলের কুড়িগ্রাম শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।
১৯৯১ সালে ছাত্রদলের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনোনীত হন ও ১৯৯২ সালে ছাত্রদলের জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে যুবদল কুড়িগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক মনোনীত হন। ২০০৩ সালে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে যুবদল কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।

তিনি ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত দুই দফায় জেলা বিএনপির কাউন্সিলে জেলার ১নং যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে কুড়িগ্রাম-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। পরবর্তীতে এই আসনটি ড. কামাল হোসেনের যুক্তফ্রন্টকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কায়কোবাদ বলেন, নদী ভাঙন রোধ, বেকারদের কমসংস্থান সৃষ্টি করব। এক সময় জাতীয় পার্টির দুর্গ হলেও এখন আর সেই অবস্থা নেই। যদি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসেও তাহলেও বিএনপি বিজয় লাভ করবে। আমি আশা করি বিএনপিকে এ আসনটি উপহার দিতে পারবে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছেন অ্যাডভোকেট ইয়াছিন
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াছিন আলী সরকার ১৯৫৯ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুড়িগ্রাম পৌর শহরের কলেজ পাড়া এলাকার মরহুম রজব আলীর ছেলে। ১৯৭৫ সালে এসএসসি, ১৯৭৭ সালে এইচএসসি, ১৯৭৯ স্নাতক ও ১৯৮১ সালে কৃষি ডিপ্লোমা এবং ১৯৮৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৮৭ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি আইন পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। বর্তমানে জেলা জামায়াতের শূরা সদস্য ও বাংলাদেশ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সদস্য এবং জেলা শাখার সভাপতি দায়িত্ব পালন করছেন।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াছিন আলী সরকার বলেন, কুড়িগ্রাম একটি দারিদ্রপীড়িত জেলা। আমি নির্বাচিত হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে একটি আইসিইউ ইউনিট চালু করা হবে। কুড়িগ্রাম জেলায় একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাব।
‘ভিশনহীন’ কুড়িগ্রামকে বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার এনসিপি প্রার্থীর
এই আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রার্থী দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ড. আতিক মুজাহিদ। তিনি ১৯৯২ সালে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঠালবাড়ি ইউনিয়নের প্রতাপ, পাঠান পাড়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাবেক স্কুল প্রধান শিক্ষক মরহুম মাওলানা আমজাদ হোসেন ও আরজুনা বেগম দম্পতির সন্তান।
ড. আতিক মুজাহিদ সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ২০২৪ সালে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ দেন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ও রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি শিক্ষা, সমাজসেবা ও জাতীয় নাগরিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন করছেন।

তিনি বলেন, কুড়িগ্রামে কোনো ভিশন নেই। কুড়িগ্রামকে একটা ভিশন দিতে চাই। আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জেলা হিসেবে বিনির্মাণ করতে চাই। কুড়িগ্রাম ৬৩নং জেলা হিসেবে থাকবে না, তিন নম্বর জেলায় রূপান্তরিত করা হবে। আমরা ত্রাণ চাই না, কর্মসংস্থান চাই, কাজের সুযোগ চাই। এই মানসিকতা তৈরি করতে হবে। নদীভাঙন প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে। স্বাস্থ্য সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। যেখানে ১১৬ জন ডাক্তারের জায়গায় মাত্র ১৩ জন ডাক্তার দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। এতে গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে আইসিইউ নেই, নারীদের স্পেশাল বেড নেই। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হলেন অধ্যক্ষ মাওলানা নূর বখত। তিনি জেলার উলিপুর উপজেলার ধামশ্রনী ইউনিয়নে ১৯৭১ সালে ১ আগস্ট মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম হোসেন আলী পেশায় একজন কৃষক।
তিনি ১৯৯০ সালে হাসিদ বিভাগ থেকে কামিল পাস করেন। ২০১৩ সালে ইসলামী শিক্ষা বিভাগ নিয়ে এমফিল পাস ও বর্তমানে পিএইচডি গবেষণারত। বর্তমানে কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদরাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পৌর সভার বানিয়া পাড়া পলাশবাড়ি এলাকায় বসবাস করছেন। তিনি ২০১২ সালে জেলা কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসাবে যোগদান করেন।

দীর্ঘদিন ধরে আসনটি জাতীয় পার্টির (জাপা) দখলে থাকলেও ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কটেনি দলটির। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পেসিডিয়াম সদস্য ও কুড়িগ্রাম-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই আসন জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে এখনো পরিচিতি আছে। যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে ৪টি আসনেই বিজয় লাভ করবে।
কুড়িগ্রাম পৌর শহরের আতিকুর রহমান বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোট দিতে পারিনি। একজন সাধারণ ভোটার হিসেবে আমি নিজের ভোটটা স্বাধীনভাবে যেন দিতে পারি এটাই চাওয়া। আর যে প্রার্থী তিনটি উপজেলায় উন্নয়ন করবে তাকেই ভোট দেবে।
কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ি ও রাজারহাট উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসন। এ আসনে ২১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ভোটার সংখ্যা পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার ২০২। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৮০ হাজার ৭৩৬, নারী ভোটার দুই লাখ ৮৬ হাজার ৪৬৩ ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার তিনজন রয়েছেন।
আরকে