খুলনা আদালতের সামনে জোড়া খুন, নেপথ্যে আধিপত্য বিস্তার নাকি অন্য কিছু?

খুলনা আদালতের সামনে ফিল্মি স্টাইলে ডাবল মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে। রোববার (৩০ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিয়ে খুলনা দায়রা জজ আদালতের মূল ফটকের সামনে বের হলে ফজলে রাব্বী রাজন ও হাসিব হাওলাদারকে গুলি ও কোপায় সন্ত্রাসীরা। নিহত দুজনই খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এমন ঘটানা নাকি এর নেপথ্যে অন্য কিছু লুকায়িত আছে? এ নিয়ে শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
নিহত ফজলে রাব্বী রাজন রূপসার বাগমারা গ্রামের এজাজ শেখের ছেলে এবং হাসিব হাওলাদার নতুন বাজার লঞ্চঘাট এলাকার মান্নান হাওলাদারের ছেলে।
নিহত রাজনের বাবা এজাজ শেখ বলেন, যৌথ বাহিনীর একটি মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিল। শুনেছি হাজিরা দিয়ে নিচে নামার পর তাকে গুলি করা হয়। তবে কারা বা কেন হত্যা করেছে তা জানা নেই।
তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলেন, আমরা কাউকে চিনি না। কোর্টের সামনে যদি নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে সন্তানকে কীভাবে বাইরে ছাড়ব? তাহলে দেশের আইন-কানুন কিসের জন্য?
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোনাডাঙ্গা থানার একটি অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিতে সকালে আদালতে আসে হাসিব হাওলাদার ও তার সহযোগী ফজলে রাব্বি রাজন। হাজিরা শেষে আদালতের প্রধান ফটকের পাশে একটি নম্বরবিহীন মোটরসাইকেলে বসে দুজন কথা বলছিলেন। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে খুলনা জেলা স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের রাস্তা দিয়ে আসা ৬-৭ জন যুবক তাদের ঘিরে হাসিব ও রাজনের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এক পর্যায়ে খুব কাছ থেকে গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই রাস্তার ওপর পড়ে যায় হাসিব। পরে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আহত রাজনকে সহযোগীরা খুলনা জেনারেল হাসপাতালে নেয়। অবস্থার অবনতি হলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, আদালতের বাইরে সড়কে তখন মানুষের ভিড় ছিল। ভরদুপুরে মানুষের সামনে হেঁটে এসে দুই যুবকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। তারা মাটিতে পড়ে গেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, খুলনা রেঞ্জ ডিআইজির বাসভবনের কিছু দূরে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে ছিল। হত্যার পর ওই মাইক্রোটি মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের সঙ্গে জিলা স্কুলের দিকে চলে যায়। গুলির ঘটনায় পুরো আদালত এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা পালিয়ে যায়। ওই প্রত্যক্ষদর্শী আরও জানান, সহযোগীরা প্রথমে হাসিবের লাশ বাড়িতে নিয়ে যায়, পরে তা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
একটি সূত্র জানায়, হাসিব ও রাজন খুলনার চিহ্নিত সন্ত্রাসী পলাশ বাহিনীর সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এ বছরের ৩০ মার্চ রাতে সোনাডাঙ্গা থানার আরামবাগ এলাকা থেকে যৌথ বাহিনী তাদের পলাশসহ গ্রেপ্তার করে। পরে তারা জামিনে মুক্তি পায়। সোনাডাঙ্গা থানার অস্ত্র মামলার হাজিরার দিন ছিল আজ। আদালত থেকে বের হওয়ার পথেই তারা দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়। সূত্রটির দাবি, খুলনার অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্ৰেনেড বাবুর গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এক প্রত্যক্ষদর্শীর মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, আদালত চত্বরের সীমানাপ্রাচীরের পাশে একজন যুবক পড়ে আছে। আরেকজন তাকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে যাচ্ছে। এ সময় পিস্তল হাতে আরও কয়েকজন আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকে এবং গুলির শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ পর পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে দলবেঁধে চলে যায় তারা।
খুলনা সদর থানার এসআই আব্দুল হাই বলেন, সন্ত্রাসীরা হাসিব ও রাজনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই হাসিবের মৃত্যু হয়। রাজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে খুলনা জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত হাসিবকে প্রথমে বাড়িতে নেওয়া হয়, এরপর তার লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
খুলনা থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল লাল ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সিআইডি, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিবি ও পিআইবির টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। নিহতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
পুলিশের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শীর্ষ দুর্বৃত্ত রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবুর গ্রুপের সঙ্গে পলাশ গ্রুপের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আগে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিছুদিন আগে কারাগারেও এই দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এর পর কারাগারে থাকা সদস্যদের দেশের বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড কি না, তা তদন্ত করা হচ্ছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড সিপি) ত. ম. রোকনুজ্জামান বলেন, নিহত দুজন পলাশ গ্রুপের সদস্য বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এলাকায় গ্রেনেড বাবু, নূর আজিমসহ একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার হলে সঠিক তথ্য জানা যাবে। সিআইডি, ডিবি ও পুলিশসহ একাধিক টিম কাজ করছে।
মোহাম্মদ মিলন/এআরবি