‘বাংলায় কথা বলায়' জোর করে পুশ ইন, ৪ ভারতীয় দেশে ফেরার অপেক্ষায়

‘বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্যই বিএসএফ জোর করে আমাদের পুশ ইন করেছে। অনেক কান্নাকাটি করে বলেছিলাম আমরা বাংলাদেশি নই, তবুও তাদের মন গলেনি।’ কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের এসব জানান ভারতীয় নাগরিক সুইটি বিবি।
শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) রাতে সোনামসজিদ সীমান্তে শূন্য লাইনে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তিনি।
জানা যায়, গতাকল শুক্রবার রাত ৮টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্তের শূন্য লাইন দিয়ে ভারতীয় নাগরিক অন্তঃসত্ত্বা সোনালী খাতুন ও তার ছেলে সাব্বির শেখকে বিএসএফের মাধ্যমে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে বিজিবি। এ সময় আরও চারজন ভারতীয় নাগরিককে হস্তান্তরের জন্য নিয়ে আসা হয়। কিন্ত বিএসএফ তাদের নিতে অপারগতা জানায়। ফলে সোনালী খাতুন ও তার ছেলে ভারত ফেরত গেলেও বাকি চারজনের ভারতে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এই চারজনকে বাংলাদেশে তাদের জিম্মাদার ফারুকের কাছে আবারও হস্তান্তর করে স্থানীয় প্রশাসন।
সুইটি বিবি বলেন, দিল্লিতে বাচ্চাসহ আমরা কাজ করতাম। একদিন সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসে। তারা জানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাবে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেবে। তখন আমি আমার ছেলের সঙ্গে থানায় যাই। পরে আমাদের থানায় রেখে দেয় দুই দিন ধরে। আমাদের ছবি, আধার কার্ডসহ সবকিছু জমা নিয়ে নিল। তারপর ফিঙ্গার নিয়ে আমাদেরকে বাংলাদেশি সাবিত (শনাক্ত) করে দিল। আমাদেরকে একটি জাহাজে করে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। আমরা অনেক কান্নাকাটি করে তাদেরকে বলেছিলাম আমরা বাংলাদেশ চিনি না, তবুও তাদের মন গলেনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। জেলখানায় ছিলাম, তখন একটু সমস্যা হয়েছিল। এই দেশের ফারুক দাদা আমাদেরকে অনেক সাপোর্ট করেছে। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাসহ কাপড় চোপড় সবকিছু দিয়েছিলো ফারুক দাদা। বিজিবিকে আমরা সম্মান করি। তারাও আমাদেরকে দেশে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে। এছাড়া শুধুমাত্র বাংলা কথা বলার জন্যই ভারতীয় বিএসএফ আমাদেরকে জোড় করে পুশইন করেছে।
ভারতীয় আরেক নাগরিক দানেশ বলেন, একদিন সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়িতে পুলিশ যায়। বলে দুই মিনিটের কথা আছে। তারপর আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিল। তারা আমাদের বলছিল, তোরা বাংলাদেশি, এখানে তোরা কি করছিস। আমরা বললাম, আমরা বাংলাদেশি নই, আমরা অনেকদিন থেকেই এখানে আছি। তারপর আমাদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দিলে এবং আমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিল। কয়েকদিন পর আমাদেরকে গাড়িতে করে আসাম বর্ডারের নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। আমাদের ওখানে কান্টিনে খাবার খাওয়ালো এবং টাকা-পয়সা দিয়ে বলল, ‘তোমরা আপনা আপনা বাড়ি চলে যাবা।’ আমরা বললাম, স্যার আমাদের তো এদিকে বাড়ি নাই। কোনদিকে যাবে। তখন তারা বলল, বেশি কথা বলো না। তারপর আমাদের সবাইকে একটি বাংলাদেশি ছেলের সঙ্গে ছেড়ে দিল। পরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামে আমাদেরকে ধাক্কা দিয়ে দিল।
জিম্মাদার ফারুক বলেন, আমি জিম্মাদার হয়ে তাদেরকে জামিন করি। জামিনের পর আমার বাড়িতে রেখেছিলাম। কাল সোনালী বেগমকে ও তার ছোট বাচ্চাকে ইন্ডিয়া নিয়েছে। আমি জানতে পেরেছি আরও চারজনকে নেবে। পরে তাদেকে আমি নিয়ে আসলাম, কিন্ত ভারত তাদেরকে নিলো না। কি কারণে নিলো না এটাও বলতে পারছি না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) এ.এন.এম ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, কোর্ট ছয়জনকে তাদের আত্মীয় ও স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক আহমেদের জিম্মায় দিয়েছিলেন। বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা ছিল ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। তারই আলোকে দুইজনকে ফিরত প্রদান করা হয়েছে। বাকি চারজনকে ফারুক আহমেদের জিম্মায় রাখা হবে। প্রতি ১০ দিন পরপর ওসি সদর মডেল থানা বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন দেবেন এবং বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা প্রতিবেদন দেব। এছাড়া তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের মাথায় রয়েছে। সোনালি খাতুন ও তার ছেলেকে হস্তান্তরের বিষয়ে আমরা বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন জমা দেব এবং বাকি চারজন বাংলাদেশে রয়েছে তাদের বিষয়েও প্রতিবেদন জমা দেব।
৫৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, সোনালী খাতুন গর্ভবতী হওয়ার কারণে মানবিক দিক বিবেচনা করে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিএসএফের মাধ্যমে মা-ছেলেকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বিএসএফের এই অমানবিক পুশ ইন কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড এবং দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত ব্যবস্থাপনা চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পুশ ইনের এই কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত এলাকায় মানবিক সংকটের সৃষ্টি করছে এবং উভয় দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
ফেরতে যেতে না পারা চারজনের বিষয়ে বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, বাকি চারজনের তথ্য আমরা বিএসএফকে প্রদান করেছি। তাদের নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদেরকে জানায়নি। তারা (বিএসএফ) বলেছে, তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চারজনের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে। যদি তারা কনফার্ম করে তখন বিএসএফ রিকুয়েস্ট করলে আমরা হান্ডওভার করব।
প্রসঙ্গত, ভারতের দিল্লিতে ইটভাটায় কাজ করার সময় গত ২৬ জুন নারী ও শিশুসহ ওই ছয়জনকে ‘বাংলাদেশি’ দেখিয়ে ভারতীয় পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায়। এরপর তারা প্রায় দুই মাস ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আলীনগর এলাকায় অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন। পরে গত ২০ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাদের আটক করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ। এরপর নিজ দেশে ফিরিয়ে ফেরত নেওয়ার কথা জানায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং তাদের একদিন পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পারায় তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
তাদের বিরুদ্ধে সীমান্তে অনুপ্রবেশ আইনে মামলা দায়েরের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে ওই ছয়জনের মধ্যে দুইজন শিশু হওয়ায় মামলায় তাদের আসামি করা হয়নি। পরে ১ ডিসেম্বর তাদের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত এবং স্থানীয় জিম্মাদার ফারুক হোসেনের বাড়িতে থাকেন তারা।
আশিক আলী/আরকে