ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক যুগে নিহত ২৪ বাংলাদেশি

ঠাকুরগাঁও সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক নীতিমালা অমান্য করে বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করছে—এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সীমানা আইনে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো নিষিদ্ধ হলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন সীমান্তে গত ১২ বছরে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২৪ জন বাংলাদেশি।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, সীমান্ত অতিক্রম না করলেই হত্যা-নির্যাতনের ঝুঁকি কমবে। তারা নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং প্রতি পতাকা বৈঠকে ভারতীয় পক্ষকে গুলি না করার বিষয়ে কঠোরভাবে জানিয়ে আসছে।
জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে পাসপোর্ট আইনে দায়ের হওয়া ৬৬ মামলায় ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে, এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১২২ জন। চলতি বছর ৫ মামলায় ২৮ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫ জন।

ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির আওতায় হরিপুর, রাণীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী ও আংশিক পীরগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ সীমান্তজুড়ে রয়েছে ১৯টি বিওপি। এর মধ্যে ১৬টি ঠাকুরগাঁওয়ে এবং তিনটি পঞ্চগড়ে। বেশ কয়েকটি সীমান্ত বেউরঝাড়ী, কান্তিভিটা, রত্ননাই, বজরুক, মুন্ডুমালা, জগদল, চাপসার, নাগরভিটা ও কান্দালে বছরের পর বছর বিএসএফের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কখনো নদীতে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, কখনো সীমান্তে ফেলে রাখা হয়েছে, আবার কখনো ধাওয়া করে হত্যা করা হয়েছে।
২০১৯ থেকে ২০২৫। এ সময়ের মধ্যে কেউ আত্মীয়ের বাড়ি যেতে গিয়েও গুলিতে মারা গেছে, কেউ ঘাস কাটতে গিয়ে, কেউ মাছ ধরতে গিয়ে। আবার কেউ হয়তো সরল মনে সীমান্তে ঘুরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। মৃত্যুর পর বহু সময় নিহতদের ‘চোরাকারবারী’ বলে আখ্যা দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে বিএসএফ। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বাস্তবতা সব সময়ই অন্যরকম ছিল।
এতগুলো পরিবারের কান্না আজও থামেনি। পিতৃহারা সন্তান, স্বামীহারা স্ত্রী, সন্তানহারা মা-বাবার জীবনে স্থায়ী দুঃসহ অন্ধকার নেমে এসেছে। কেউ নিঃস্ব, কেউ দিশেহারা, কেউ চিকিৎসা খরচও জোগাতে পারছে না।
হরিপুরের রাসেল হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার মা সেলিনা বেগম বলেন, ‘মোর ছুয়াডা একটু বোকা ছিল। মানুষ কী বুঝাইছে আর কীভেবে গেছে বুঝি না। কিন্তু তাই বলে গুলি করে মারবে! ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দিনাজপুর ৪২ বিজিবির আওতায় চাপসার সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় রাসেল।’
গত বছর সেপ্টেম্বরে রাণীশংকৈলের ধর্মগড় সীমান্তে নানার বাড়ি যাওয়ার পথে বিএসএফের গুলিতে মারা যায় ১৫ বছর বয়সী কিশোর জয়ন্ত। মরদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে তার বাবা মহাদেবও গুলিবিদ্ধ হন। নানির কান্না এখনও থামেনি। মুন্ডুমালা সীমান্তে নিহত শাহ আলমের পরিবারও একই পরিণতির মুখে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তার মা-বাবা আজ অসহায়। কারো চিকিৎসা চালানোরও সক্ষমতা নেই।
বেউরঝাড়ী সীমান্তের নিহত নুরুজ্জামানের স্ত্রী আলেফা বেগম বলেন, ‘স্বামী ছাড়া সংসার চলে না। দুই ছেলেকে নিয়ে কি করি। বিজিবি তাকে চোরাকারবারী ট্যাগ দিলেও পরিবার তা মানতে নারাজ।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সীমান্তে বিনা কারণে তাড়ানো, ভয় দেখানো কিংবা গুলি করার ঘটনা বারবার ঘটছে। জমিতে ঘাস কাটতে যাওয়া, কৃষিকাজ করা সবেতেই শঙ্কা।
সীমান্তঘেঁষা স্থানীয় মানিক নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা চাই সীমান্তে কাটাতাঁরের বেড়া হোক। তাহলে বিএসএফ আর আমাদের চোরাকারবারী বলে দোষ চাপাতে পারবে না।’
সাংস্কৃতিক কর্মী মাসুদ আহম্মেদ সূবর্ণ মনে করেন, দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। সরকার বদলালেই ভারতের প্রতি নতজানু নীতি চলে আসে। বাংলাদেশকে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব মাহাবুব আলম রুবেলের ভাষ্য, ফেলানীর মতো ন্যায়বিচারবঞ্চিত অসংখ্য পরিবার রয়েছে। এসব মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণও পাওয়ার অধিকার তাদের আছে।
ঠাকুরগাঁও লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) মজনু মিয়া সীমান্তে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সীমান্তে যেসব মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের কেউ এখনো ন্যায়ের জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে আসেননি। অথচ এই দেশের প্রতিটি নাগরিকই সংবিধান অনুযায়ী বিচার পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে। আইন কখনো কাউকে একা ফেলে রাখে না।
তিনি আরও বলেন, বিচার চাওয়া কোনো অপরাধ নয়, এটা একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। যদি কোনো ভুক্তভোগী পরিবার আমাদের কাছে আসে, আমরা বিনা খরচে প্রয়োজনীয় সব ধরনের আইনি সহায়তা দেব। মামলা করার প্রয়োজন হলে সে পথও আমরা খুলে দেব। সীমান্তে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবার যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় এটা রাষ্ট্রের দায়, আর সেই দায় পালন করতেই আমরা এখানে আছি।
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজীর আহম্মদ সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, সীমান্তে প্রাণহানির সবচেয়ে বড় কারণ হলো সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা। মানুষ সীমান্ত না পেরোলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটার সুযোগই থাকে না। তাই আমরা শুরু থেকেই চোরাকারবারি, নিয়ম অমান্যকারী কিংবা সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা করি। শুধু পরিবার নয়, স্থানীয় ইমাম, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে সচেতনতামূলক উদ্যোগে। তারা গ্রামের মানুষের কাছে বারবার বিষয়গুলো পৌঁছে দিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, রংপুর রিজিয়নের অধীনে ৪টি সেক্টর ও ১৫টি ব্যাটালিয়ন মিলে প্রায় ১,৬৬০ কিলোমিটার সীমান্ত আমাদের দায়িত্বে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও সীমান্তের দূরত্ব ১০৬.৪ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ এলাকায় মানবপাচার রোধ, মাদকবিরোধী অভিযান, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় আনাসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা যুগপৎ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষ সচেতন হলে, আইন মেনে চললে, সহযোগিতা করলে সীমান্ত আরও শান্ত হবে। আর এই শান্ত সীমান্তই হবে দুই দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও সৌহার্দ্যের ভিত্তি।
রেদওয়ান মিলন/এএমকে