আলফাডাঙ্গার নিভৃত পল্লীতে তৈরি হচ্ছে জামদানি শাড়ি

আনুমানিক ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট একটি টিনের ঘর। ঘরের দুই পাশের বেড়ায় টিন কেটে মাঝে জালি বসানো হয়েছে, যাতে ঘরে আলো-বাতাস ঢুকতে পারে। এর মধ্যে সারিভাবে সাজানো রয়েছে ছয়টি তাত। প্রতি তাতে দুজন করে একসঙ্গে ১২ জন কাজ করতে পারেন।
ছোট্ট এই ঘরে রেশম সুতা, বাইনা সুতা ও জরি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে উন্নতমানের জামদানি শাড়ি। প্রকারভেদে প্রতিটি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা মূল্যে।
ফরিদপুর সদর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলা লাগোয়া ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল গ্রাম। এখানেই জামদানি শাড়ি তৈরি করছেন মো. মোস্তাফিজুর রহমান (৩৪) নামে এক ব্যক্তি। তিনি ওই গ্রামের বাসিন্দা মৃত আতিয়ার রহমান ও মৃত রিনা বেগমের একমাত্র সন্তান।
অভাবের সংসারে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। কারণ শৈশব থেকেই জীবন ও জীবিকার সন্ধানে নিয়োজিত করেন নিজেকে।

১৬ বছর বয়সে ২০০৭ সালে তিনি চলে যান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার জামদানি পল্লিতে। সেখানেই তিনি জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শেখেন। তার ওস্তাদ হারিস মিয়া ও আনোয়ার সর্দার নামে দুই কারিগর। কাজ শিখে রূপগঞ্জেই একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। এভাবে ওই রূপগঞ্জেই কাটিয়ে দেন জীবনের ১৪টি বছর। এক সময় মাটি তাকে টানতে থাকে। মন চায় নিজ এলাকায় ফিরতে। সেই মাটির টানে ‘প্রবাসী’ জীবনের যবনিকা কাটিয়ে ২০২১ সালে তিনি ফিরে আসেন নিজ জেলা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার পানাইল গ্রামের নিজ বাড়িতে। নিজ বাড়িতে আসার পর একটি তাঁত বসিয়ে জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন ওই ছাপড়া ঘরে।
ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসা এবং তাঁতের কাজ এলাকার লোকদের শিখিয়ে তাদের সাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে গ্রামে এসে জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন মোস্তাফিজুর। এখন তার মোট ছয়টি তাঁত। এসব তাঁতে কাজ করছেন তিনিসহ ১২ জন। ইতোমধ্যে স্ত্রী নিলা বেগম তাঁতের কাজ শিখে নিয়েছেন। তিনিও সাংসারিক কাজ শেষে স্বামীর সঙ্গে কাজ করেন।
মোস্তাফিজুরের শাড়ির কারখানায় কারিগর হিসেবে কাজ করেন আলফাডাঙ্গার টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল গ্রামের মোহাম্মদ হোসাইন (২৯)। আগে তিনি রূপগঞ্জে কাজ করতেন। পরে এলাকায় এসে মোস্তাফিজুরের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, এলাকায় যখন এ কাজ শুরু হলো এবং দেখলাম সুযোগ-সুবিধা একই, এজন্য আমি মোস্তাফিজুর ভাইয়ের কারখানায় এসে যোগ দিয়েছি। ঘরের ভাত খেয়ে কাজ করতে পারছি। এতে আমার লাভই হচ্ছে।

রেশমি সুতা, সুতি সুতা ও জরি দিয়ে এ শাড়িগুলো তৈরি করা হয়। একটা শাড়িতে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ রেশমি সুতার সারি থাকে। রেশমি সুতা কেনা হয় রাজশাহী থেকে। একটি শাড়ির পেছনে সুতার খরচ বাবদ ব্যয় হয় অন্তত ২ হাজার টাকা। সুতা কেনা থেকে শুরু করে কারিগরদের বেতন দেওয়ার পরও প্রতিমাসে তার ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ থাকে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলার সাবেক ইউএনও (বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক পদে কর্মরত) শারমিন ইয়াসমিন বলেন, আমি যখন আলফাডাঙ্গায় ইউএনও হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম, সে সময় মোস্তাফিজুরের কাছ থেকে অনেকগুলো জামদানি শাড়ি আমি কিনেছি। এর আগে আমি নারায়ণগঞ্জ থেকেও বেশ কয়েকটি জামদানি শাড়ি কিনেছি। সেগুলোর থেকে মোস্তাফিজুরের শাড়ির গুণগত মান অনেক ভালো।
তিনি বলেন, জামদানি শাড়িতে অনেক মারপ্যাঁচ আছে, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এক ইঞ্চি শাড়ি ছোট হলেও বিক্রেতার লাভ। তবে মোস্তাফিজুরের শাড়ির দৈর্ঘ্য যেমন বড়, প্রস্থও তেমন বড়। এককথায় বলা যায়, মোস্তাফিজুরের হাতের কাজ অসাধারণ।

মোস্তাফিজুরের শাড়ি ক্রেতারা তার বাড়িতে এসে কিনে নেন। আবার বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে আগে থেকেই তাকে শাড়ির অর্ডার দিয়ে রাখেন। আবার অনেক সময় রূপগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরীতেও পাঠান তার শাড়ি।
নিজের কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই। শাড়ির জন্য তার বিনিয়োগ ৫ লাখ টাকা। শাড়ি বিপণনের জন্য তিনি একটি নামও দিয়েছেন— ‘মুসলিম জামদানি ঘর’। যদিও বাড়ির কোথাও এ নামে কোনো সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়নি।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদরের বাসিন্দা দিপ্তি কুণ্ডু বলেন, আমাদের গর্বের বিষয় আলফাডাঙ্গাতেই উন্নত মানের শাড়ি প্রস্তুত করছেন মোস্তাফিজুর। সরাসরি তার কাছ থেকে শাড়ি কিনতে পেরে আমরা খুশি।
তিনি আরও বলেন, যে মানের শাড়িতে মোস্তাফিজুর যে টাকা নেন, এ মানের একটি শাড়ি অন্য কোনো দোকানে গিয়ে কিনতে হলে অন্তত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়। তাই মোস্তাফিজুরের শাড়িই আমাদের ভরসা। তা ছাড়া, অন্য জায়গার জামদানি শাড়ির সঙ্গে তুলনা করলে মোস্তাফিজুরের শাড়ির মান ভালো। তার কাছ থেকে শাড়ি কিনে আমি কখনো ঠকিনি।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরির ‘রাজন জামদানি হাউস’ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি মোস্তাফিজুরের জামদানি শাড়ি বিক্রি করে।
ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক নুর আলম বলেন, মোস্তাফিজুরের জামদানি শাড়ি অরিজিনাল জামদানি। ওর কাজ অসাধারণ। এ কাজে ওর দক্ষতা শতভাগ। ‘একশতে একশ মোস্তাফিজুরের তৈরি জামদানি শাড়ি।’ আমরা পাইকারি বিক্রেতা। মোস্তাফিজুর শাড়ি বানিয়ে আমাদের দেন, আমরা বিক্রি করি।
মোস্তাফিজুর বলেন, ‘আমি নিজের যোগ্যতায় এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছি। তবে সারা বছরই জনবলের সংকট থাকে। তার পরও আমি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, অনেকে বলেন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তৈরি জামদানি শাড়ির মান ভালো। এ মিথ আমি ভেঙে দিয়েছি। সঠিক উপকরণের সঠিক ব্যবহার করলে এবং কাজের প্রতি মমত্ববোধ ও একাগ্রতা থাকলে দেশের যে কোনো জায়গা থেকেই ভালো মানের জামদানি শাড়ি প্রস্তুত করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। নিজের পুঁজিতে যতটুকু করে যাওয়া সম্ভব তা করে যাচ্ছি।
মোস্তাফিজুরের ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে টগরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মিয়া আসাদুজ্জামান বলেন, মোস্তাফিজুর আমাদের এলাকার গর্ব। তার তৈরি জামদানি শাড়ি সবার প্রিয় ও পছন্দের। আমার প্রত্যাশা, মোস্তাফিজকে কেন্দ্র করে এ এলাকায় জামদানি শাড়ি তৈরির একটি কেন্দ্র গড়ে তোলা হোক। এজন্য আমি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানাই, তারা যেন আমাদের আশা পূরণে এগিয়ে আসেন।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের ভাঙ্গা বেসিক সেন্টারের লিয়াজো কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. মামুনুর রশিদ বলেন, কোনো তাঁতিকে তাঁত বোর্ডের অধীনে প্রশিক্ষণ দিতে হলে তাঁতি সমিতির সদস্য হতে হয়। আলফাডাঙ্গার মোস্তাফিজুর জামদানি তৈরি করেন, তবে তিনি কোনো তাঁতি সমিতির সদস্য নন। তাকে আমি তাঁতি সমিতির সদস্য হতে বলেছিলাম।
তিনি বলেন, ওনার যারা তাঁতের কাজ করেন, সবাইকে নিয়ে একটা সমিতি তৈরি করতে বলেছিলাম। তাহলে তাদেরকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম। দেশের যেসব জেলায় তাঁতির সংখ্যা বেশি- যেমন নরসিংদী, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ এবং কুষ্টিয়াতে সমিতির মাধ্যমে তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। ফরিদপুর অঞ্চলে কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। তাই আমরা এই এলাকার তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি না।
জহির হোসেন/এএমকে