মাদরাসার বারান্দা থেকে রাজপথ, ইনসাফের কণ্ঠ আজ আইসিইউতে

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার হাড়ীখালী গ্রাম। এই গ্রামেই মুন্সি বাড়ির উঠোনে এক সময় তিনি বাবার কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনে বড় হয়েছেন। মাদরাসায় পড়াশোনার হাতে খড়ি হলেও রাজনীতি, আন্দোলন ও বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে তিনি অসংখ্য দেশপ্রেমিকের কাছে অনুপ্রেরণার নাম হয়ে ওঠেন। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ন্যায় ও ইনসাফের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার। সেই ছোট ছেলেটিই আজ রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। তিনি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি- জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে আলোচিত এক তরুণ নেতৃত্ব। সেই ওসমান হাদিকে প্রকাশ্য রাজপথে গুলি করার ঘটনায় সর্বমহলে নিন্দা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার হাড়ীখালী গ্রামের মুন্সি বাড়িতে। তার বাবা মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদী ছিলেন নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ এবং স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত ও সম্মানিত একজন আলেম। তিন ভাই ও তিন বোনের পরিবারে ওসমান হাদি ছিলেন সবার ছোট।
তার বড় ভাই মাওলানা আবু বক্কর ছিদ্দিক বরিশাল গুঠিয়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব। মেঝ ভাই ওমর ফারুক ঢাকায় ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বোনদের পরিবারও শিক্ষা ও ধর্মীয় পরিবেশে গড়ে উঠেছে।
শিক্ষাজীবনের শুরু বাবার কর্মস্থল নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। পরে তিনি ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী ও দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝালকাঠির নেছারাবাদ এন এস কামিল মাদ্রাসায়। এখানেই বক্তৃতা, আবৃত্তি ও যুক্তিনির্ভর আলোচনায় তার দক্ষতা শিক্ষকদের পাশাপাশি সহপাঠীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আবৃত্তি ও উপস্থিত বক্তৃতায় তিনি ছিলেন বিশেষভাবে পারদর্শী। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এবং অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকেই অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও জনগণের সম্পর্ক নিয়ে তার চিন্তাভাবনার শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি অধিকার সচেতন ছিলেন এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ওসমান হাদি এক বিপ্লবী নেতৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। জুলাই-আগস্টে ঢাকার রামপুরা এলাকায় বসবাসকারী হাদি আন্দোলনের সময় স্থানীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলায় তিনি ছিলেন সক্রিয়। রাজপথে ছাত্র-জনতার পাশে থাকা, আন্দোলন সংগঠিত করা ও আহতদের সহায়তা- সব ক্ষেত্রেই তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
৫ আগস্টের পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে এবং বিভিন্ন দাবির ভিত্তিতে তিনি ১৩ আগস্ট ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে ইনকিলাব মঞ্চের যাত্রা শুরু করেন। সংগঠনটির মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শরিফ ওসমান হাদি এবং সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন আব্দুল্লাহ আল জাবের। সংগঠনটির লক্ষ্য হলো- সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং পুরনো ধারার রাজনীতির কঠোর সমালোচনাসহ নানা বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার কারণে বর্তমান বাংলাদেশে ওসমান হাদি ব্যাপক আলোচনায় রয়েছেন।
ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় তার জন্মভূমি ঝালকাঠি ও নলছিটিসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। তার দ্রুত সুস্থতা কামনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝালকাঠির নেছারাবাদ এন এস কামিল মাদ্রাসায় দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ওসমান হাদি বরিশালের রহমতপুরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি এক পুত্রসন্তানের জনক। বর্তমানে তিনি ঢাকার রামপুরায় বসবাস করতেন। তার বৃদ্ধা মা-সহ পরিবারের সবাই বর্তমানে ঢাকাতেই অবস্থান করছেন।
হাদির পরিবারের সুপরিচিত নলছিটির আল আমিন তালুকদার বলেন, ওসমান হাদির ব্যক্তিত্ব হঠাৎ তৈরি হয়নি। তার বাবার আদর্শ, শাসন ও মানবিকতা- এই তিনটি বিষয়ই তাকে গড়ে তুলেছে। ছোটবেলা থেকেই আমি হাদির বাবাকে একজন সৎ ও আলেম মানুষ হিসেবে দেখেছি। তার শাসন ছিল কঠোর, তবে সেই কঠোরতার ভেতরেই ছিল ন্যায়বোধ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার শিক্ষা। এ কারণেই ওসমান হাদি কখনো নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখেনি, বরং সব সময় সমাজের কথা ভেবেছে। পারিবারিক আদর্শই শরিফ ওসমান হাদিকে আজকের ওসমান হাদি বানিয়েছে।
হাদির সহপাঠী ইসমাইল মুসাফির বলেন, হাদি কখনোই সুবিধাবাদী ছিল না- এটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমরা যখন নিরাপদ পথে চলতে চাইতাম, তখন সে বলত, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হয়। সে বিশ্বাস করত, চুপ থাকা মানেই অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা। জুলাই আন্দোলনে সে সামনে থাকবে- এটা আমরা আগেই বুঝেছিলাম। কারণ, ছোট বয়স থেকেই সে রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব ছিল। দেশ, জাতি ও সমাজের পরিবর্তন নিয়ে সে সব সময় কথা বলত এবং অন্যায় দেখলে সামনে গিয়ে নেতৃত্ব দিত।
তার সরাসরি শিক্ষক মাওলানা এসহাক আহমেদ বলেন, আমি তাকে ছাত্র হিসেবে পড়িয়েছি, বক্তা হিসেবেও দেখেছি। কিন্তু জুলাইয়ের পর সে আর শুধু ছাত্র বা বক্তা ছিল না- সে হয়ে ওঠে এক রাজনৈতিক বিপ্লবী কণ্ঠ। ক্লাসরুমে তার প্রশ্নগুলো সব সময় আলাদা ছিল, পাঠ্যবইয়ের বাইরের সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে সে ভাবত। আন্দোলনের সময় সেই চিন্তাগুলোই তাকে মানুষের কণ্ঠস্বর বানিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ঝালকাঠি জেলা কমিটির আহ্বায়ক মাইনুল ইসলাম মান্নান বলেন, জুলাই বিপ্লবে ওসমান হাদি আমাদের একজন সহযোদ্ধা। তার দেশপ্রেম ও আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তার ওপর হামলা মানে শুধু একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়, এটি পুরো জুলাই বিপ্লবের ওপর আঘাত, আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপরও বড় আঘাত। ওসমান হাদির কণ্ঠ রোধ করা মানে পুরো বাংলাদেশের কণ্ঠ রোধ করা। আমরা এই হামলার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই, যাতে ভবিষ্যতে কেউ প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করার সাহস না পায়।
ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা গাজী শহীদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওসমান হাদি আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী। এই মাদ্রাসায় কর্মরত অবস্থায় আমি তাকে পাইনি, তবে সহকর্মীদের কাছ থেকে তার প্রতিভা ও দেশপ্রেমের কথা শুনেছি। ছাত্রজীবন থেকেই সে অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল। শুধু ভালো ফলাফল নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তার গভীর চিন্তা আমাদের নজর কেড়েছিল। অন্যায় দেখলে সে প্রশ্ন তুলত ও যুক্তি দিত। আজ সে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তাতে আমরা বিস্মিত নই, বরং মনে করি, এটাই ছিল তার স্বাভাবিক গন্তব্য। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক।
এর আগে শুক্রবার দুপুর আনুমানিক সোয়া দুইটার দিকে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুই ব্যক্তি খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকদের বরাতে জানা গেছে, তার অবস্থা এখনও গুরুতর এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
মাদ্রাসার শৃঙ্খলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত চিন্তা ও রাজপথের বাস্তবতা- এই তিন ধারার সংমিশ্রণেই গড়ে উঠেছে ওসমান হাদি। আজ তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে, কিন্তু তাকে ঘিরে আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট- তিনি আর কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। গুলির শব্দে তার কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়া যাবে কি না- এই প্রশ্নই এখন রাজপথ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এআরবি