নতুন পাকা ঘরের স্বপ্ন অপূর্ণই রইল শহীদ জাহাঙ্গীরের

অল্প অল্প টাকা জমিয়ে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল একটি পাকা বাড়ি নির্মাণের। সেই বাড়িতেই বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার গড়বেন—এমন স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিন গুনছিলেন শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে শহীদ জাহাঙ্গীর আলম।
বাড়িটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। ভেবেছিলেন, মিশন শেষে দেশে ফিরে অসমাপ্ত কাজ শেষ করে উঠবেন স্বপ্নের পাকা ঘরে। কিন্তু আর ফেরা হলো না তার। এক দুর্ঘটনায় তার সেই স্বপ্ন আজ স্বপ্নই থেকে গেল।
সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সদস্য। স্বপ্নের পাকা বাড়িটি এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে শোক আর কান্নার প্রতীক হয়ে।

নিহতের বৃদ্ধ বাবা-মা বারবার পাকা ঘরে ঢুকে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমার বাবা আর এই ঘরে আসবে না।
নিহতের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার বলেন, কত স্বপ্ন ছিল এই ঘর সাজাবো, আর টিনের ঘরে থাকতে হবে না। কিন্তু তুমি আর আসবে না। যদি জানতাম এই পোশাক আমার স্বামীকে কেড়ে নেবে, তাহলে কোনো দিনই মিশনে যেতে দিতাম না। এই কথা বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।
নিহতের বাড়িতে শোক জানাতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি পাকুন্দিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাত জাহান। স্বজনদের আহাজারি দেখে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যে ক্যামেরার সামনে কথা বলতেও পারছিলেন না।

এ ছাড়া, খবর পেয়ে নিহতের বাড়িতে ছুটে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুপম দাস। তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক খুদে বার্তায় জানায়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হন এবং অন্তত আটজন আহত হন। হামলার পরও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। পুরো এলাকা এখনো অস্থিতিশীল রয়েছে।
নিহতদের মধ্যে একজন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের আকন্দ বাড়ির হজরত আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৩০)। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেসওয়েটার পদে কর্মরত ছিলেন। তার ব্যক্তিগত নম্বর (সিএস-২২০১০৯)।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিন ভাইয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন মেজো। তার বড় ভাই মো. মোস্তফা প্রবাসে কর্মরত এবং ছোট ভাই মো. শাহিন মিয়া বাড়িতে কৃষিকাজ করেন।
প্রায় ১১ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের স্বপ্ন নিয়ে এক মাস সাত দিন আগে গত ৭ নভেম্বর—পরিবারের চোখের জল আর বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে তিনি সুদানে যান।

স্ত্রী ও তিন বছরের একমাত্র ছেলে ইরফানকে রেখে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। বাবার আদর কী—তা বোঝার আগেই চিরতরে পিতৃহারা হলো ছোট্ট ইরফান।
জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর খবরে তারাকান্দি গ্রাম যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা বলছেন, শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেলেন। এলাকায় শোকের মাতম চলছে। সবাই এক কণ্ঠে শহীদ জাহাঙ্গীর আলমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছেন এবং তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
মোহাম্মদ এনামুল হক হৃদয়/এএমকে