পায়ে গুলির ক্ষত চোখে অশ্রু, ৫৪ বছরেও গেজেটভুক্ত হননি যুদ্ধাহত লাল মিয়া

৬ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী, বৃদ্ধা মা ও ভাই-বোনদের রেখে চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাক-হানাদার বাহিনীর অস্ত্রের মুখে। পায়ে গুলি লেগে হয়েছেন আহত। রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের অগ্নিসংযোগে হারিয়েছেন নিজ আশ্রয়স্থল। বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। এদেশকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা।
তবে বিজয়ের ৫৪ বছরেও সরকারের গেজেটভুক্ত হয়নি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া শেখের নাম। মাসিক ভাতা ও ঘরসহ কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া শেখের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের ইশিবপুর গ্রামে। তিনি একই গ্রামের মৃত হামিদ শেখের ছেলে।
তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন ৮৫ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া। পাক-হানাদার বাহিনীর বুলেটের ক্ষত নিয়ে লাঠিভর দিয়ে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তার শয়নকক্ষে ভাঙা খাট, ছ্যাঁতছ্যাতে পরিবেশ। চোখের চশমাটাও কসটেপ দিয়ে জোড়ানো। তার স্ত্রী আজুফা বেগমও বয়সের ভারে কোনো কাজ করতে পারেন না। দর্জি ও ট্রাকচালক দুই ছেলের সহায়তায় খেয়ে-পড়ে অসহায় অবস্থায় কাটছে তাদের জীবন।

পরিবার ও স্থানীয়রা জানায়, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া শেখ ও আজুফা বেগম দম্পতির ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে ছিল। এর মধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ায় তারা শ্বশুরবাড়ি থাকেন এবং ছোট ছেলে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে ২০০২ সালে মারা গেছে। বর্তমানে লাল মিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে বড় ও মেজো ছেলের সংসারে বসবাস করেন। বড় ছেলে মো. হারুন শেখ ইশিবপুর বাজারে দর্জির কাজ করেন এবং মেজো ছেলে ট্রাকচালক। ছেলেদের অভাবের সংসারে কোনো রকম তিন বেলা খেতে পারলেও, চলে না চিকিৎসা খরচ।
পরিবার ও নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে যে ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন তিনি আজ অসহায়। তার রয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটির সনদ, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত একাধিক চিঠি ও জাতীয় অনুষ্ঠানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নিমন্ত্রণপত্র। তবুও গেজেটভুক্ত হননি তিনি। হাইকোর্টে রিট করেও পাননি সমাধান। পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে লাল মিয়াকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর ও মাসিক ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবার ও এলাকাবাসী।

এ ব্যাপারে ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া শেখের। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করলাম, গুলি খাইলাম কিন্তু আমার ভাগ্যে কিছুই জুটলো না, আমার নামটাও সরকারি তালিকায় উঠলো না। এই ৫৪ বছরে আমি কিছুই পাই নাই। আমি খুব কষ্টের মধ্যে আছি। সরকারের কাছে দাবি মরার আগে আমার নামটা যেন সরকারি খাতায় দেইখা যাইতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে লাল মিয়া শেখ বলেন, বাড়িতে গর্ভবতী স্ত্রীসহ মা-ভাই ও বোনদের রাইখা যুদ্ধ করতে গেছিলাম। এদিকে আমার ঘর বাড়িসহ সব কিছুই আগুন দিয়া পোড়াই দেয় রাজাকার-আলসামসরা। তখন আমার পরিবারের লোকজন পাশের গ্রামে গিয়া পালিইছিল। আল্লাহ তাদেরকে বাঁচাই রাখছেন। আমিও যে ফিরা আসতে পারব তা কোনদিন ভাবতে পারিনি। যশোরে থাকছি, ৬ মাস যুদ্ধ করছি। আমাগো কমান্ডার ছিল আবু সুফিয়ান। তাকে পাকবাহিনী রাজাকাররা মাইরা ফেলাইছে। আমার পায়ে গুলি লাগার পর প্রথমে যশোর ক্যান্টনমেন্টের ডাক্তার খানায় নেয়। পরে খুলনা মেডিকেলে পাঠায়। কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফিরা যাই। বিজয়ের পর তালিকা করে অস্ত্র জমা নিয়ে সবাইকে গ্রামে যেতে বললে বাড়িতে এসে ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাই। বিভিন্ন জায়গায় খবর দেওয়ার পর পরিবারের সবাইকে খুঁজে পাইছি।
যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, এখান থেকে নৌকা ভাড়া কইরা রাতের বেলা এক সঙ্গে ৭৫ জন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য রওনা করি। প্রথমে যশোর গেছি। ওইখান থিকা কালীনজির বর্ডার গিয়া দুই দিন আখ ক্ষেতে পালাই ছিলাম। এরপর আবার রাতে একগিরা (এক হাটু) কাদার মধ্যে দিয়া পায়ে হাইটা কবুতরের গাং পাড়ে গিয়া উঠি। পরে উলঙ্গ হইয়া গাং পাড় হই। জামাকাপড় ভিজা যাওয়ায় ভারতের বানারীপাড়ায় একটা বাড়িতে যাই এবং একটা গামছা চাইয়া নেই। পরে জামাকাপড় গায়ে দিয়া শুকাই। এরপর হাঁটতে হাঁটতে বনগাঁ আর্মিগো অফিসে গেলে আমাগো ভর্তি করে। একদিন রাখার পর চাঁদপাড়া ক্যাম্পে পাঠায়, ওইখান থিকা আবার কয়েকদিন পর গাড়িতে করে বিহার চাকলিয়া পাঠায়। সেইখানে তাম্বুরার মধ্যে থাকতাম আর মাথার নিচে ইট দিয়া ঘুমাইতাম, কোন বালিস কাতা ছিল না। খিচুড়ি খাইতে দিত। ২১ দিন ট্রেনিং শেষে আবার বনগাঁ আর্মি অফিসে আইনা একদিন রাখে। পরে আমাদের প্রত্যেকের কাছে এন্টি ট্যাংক মাইন্ড, হ্যান্ড গ্রেনেড, থ্রি বাফোর রাইফেল ও ৬০ রাউন্ড গুলি দিলে যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশে আসি। আমরা এক সঙ্গে ১০৫ জন ছিলাম।

যুদ্ধে ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া শেখ বলেন, কালীনজিরি বর্ডার পার হইয়া এই পাড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার ও পাক-সেনাগো দেখা পাই। আমাগো দেইখা তারা প্রচুর গুলি চালায়। সেই সময় রাস্তায় ভাঙনের আড়ালে মাথা ঢুকাই রাখি। তখন আমাগো ওপর দিয়া সব গুলি চইলা যায়। পরে আমরা গুলি কইরা সইরা যাই। পরবর্তীতে যশোর ক্যান্টনমেন্টের চারদিকে ৪টা মেশিন ফিট কইরা ভেতরে পানি দিয়া ভইরা ফেলাই। এই সময় ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থাকা সব পাক-সেনারা ডুইবা মইরা যায়। পরে ক্রোল করে ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়া আসার সময় হানাদার বাহিনী গুলি ছাড়লে আমার ডান পায়ে গুলি লাগে। ওই গুলিতে ৩০ জন মারা যায় আর আমরা ৭৫ জন জীবিত ছিলাম।
লাল মিয়া শেখের স্ত্রী বৃদ্ধা আজুফা বেগম বলেন, মানুষটা দেশের জন্য এতো কিছু করলো কিন্তু সরকারি খাতায় নাম উঠলো না। একজন সরকারি খাতায় নাম উঠাই দেবে আর ভাতা পাওয়াই দেওয়ার কথা কইয়া অনেক টাকা নেছে। কিন্তু কিছুই করে নাই। রাত হলেই এই কষ্টে মানুষটা কান্নাকাটি করে। খালি কয় সরকারি টাকা পয়সা পাই বা নাই কিন্তু সরকারি খাতায় যদি নামটা উঠতো তাও কষ্ট থাকতো না। কাগজপত্র নিয়া অনেক দৌড়াইছে, চেষ্টা করছে। হাইকোর্টে মামলা কইরা রায় পাইছে। অনেক চিঠি আইছে। মুক্তিযোদ্ধার অনেক কগজপত্রও আছে কিন্তু সরকারি খাতায় নাম উঠে নাই। আমাদের দাবি কিছু দেউক আর না দেউক আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছাটা যেন সরকার পূরণ করে। সরকারি খাতায় যেন নামটা ওঠে। মরার আগে যেন আমরা দেইখা জাইতে পারি।
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি দিলে আমরা কাজ করতে পারি। যদি তিনি কোনো রায় পেয়ে থাকেন তাহলে সেটা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন। পরে আমাদের কাছে পাঠাবে। বর্তমানে পুরনো মুক্তিযোদ্ধারাই মাসে মাসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ভাতা পাচ্ছেন।
আকাশ আহম্মেদ/আরকে