পাক-হানাদারদের দেওয়া আগুনে পোড়া ঘরে এখনও বসবাস করেন নিরঞ্জন তালুকদার

মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আছে খবর পেয়ে ভোর ৪টার দিকে অতর্কিত হামলা চালায় পাক-হানাদার বাহিনী। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ প্রায় সাড়ে তিনশো মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তারা। একই সাথে পুড়িয়ে দেয় ৪-৫টি গ্রামের ঘর-বাড়ি। আজও সেইসব নৃশংসতার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন তালুকদার। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বসবাস করেন পাক-হানাদারদের আগুনে পোড়া ঘরে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন তালুকদার কেন্দুয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তিনি যুদ্ধ করেছেন দুই নম্বর সেক্টরে খলিল বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে। দুই ছেলে সরকারি চাকরি পাওয়ায় বীর নিবাসের ঘর দেওয়া হয়নি তাকে।
ঢাকা পোস্টের কাছে পাক-বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলসামদের নির্মমতার ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন তালুকদার। তিনি বলেন, সময়টা তখন ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর। ঘড়ির কাটা ভোররাত ৪টার ঘরে। অধিকাংশ মানুষই ছিল গভীর ঘুমে। এরই মধ্যে অতর্কিত হামলা চালায় পাক-হানাদাররা। তারা জানতে পেরে যায় বাহাদুরপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প রয়েছে। পশ্চিম বাহাদুরপুর গ্রামে পালিয়ে থাকা মানুষের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে হানাদার বাহিনী। যেদিক দিয়ে গেছে সামনে যাকে পেয়েছে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ কাউকেই ছাড়ে নাই। সেই সময় প্রায় তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো মানুষ হত্যা করে পাক-সেনারা।

নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, আমরা খলিল বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে ছুটে যাই। কিন্তু তাদের অতর্কিত হামলার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারি নাই। পরে তাৎক্ষণিক গ্রামের আরেক পাশে পাক-হানাদারদের হামলার খবর জানিয়ে বাড়ি থেকে সরে যেতে বলি। এসময় সবাই জীবন বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। একপর্যায়ে পাশের পুকুরে গিয়ে সবাই পালিয়ে যায়। আমরা চলে যাই বিলের মধ্যে। ওই সময় আমাদের গ্রামের কিছু ছেলেকে ধরে নিয়ে আমার বাড়ি চিহ্নিত করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে তাদেরকেও মেরে ফেলে। শুধু তাই নয়, ৪-৫ গ্রামের প্রায় দেড়শো থেকে দুইশো ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
বিজয় অর্জনের ইতিহাস তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন তালুকদার বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ থেকে ১০ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সমাদ্দার ব্রিজের দুইপাশে টানা ৩ দিন সম্মুখে তুমুল যুদ্ধ চলে। এসময় গ্রেনেড মেরে পাক-বাহিনীর বাঙ্কার ভাঙতে গিয়ে হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। পরে ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে আমাদের খলিল বাহিনীর প্রধান খলিলুর রহমান খানের কাছে রাইফেল জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাক-বাহিনী। সেইদিনই হানাদার মুক্ত হয় মাদারীপুর জেলা। এরপর বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। সারাদেশের মধ্যে একমাত্র খলিল বাহিনীর কাছেই পাক-হানাদাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের খলিল বাহিনী বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে।
স্মৃতি ধরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, গণহত্যা ও আমাদের বৃহত্তর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের স্মৃতি ধরে রাখতে বাহাদুরপুরে একটি বদ্ধভূমির স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছেন সরকার। কিন্তু কেউ জানে না এটা কি। তখন মানুষকে বুঝাতে হয়। তাই আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও বদ্ধভূমি সম্পর্কে জানাতে প্রতিটি স্কুলে গিয়ে এবং নাতি-নাতনিদের আমরা মাঝে মাঝে গল্প শুনাই। তাদেরকে বলি এখানে ৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল এবং একদিনে এই গ্রামের শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তাই এই স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। এই তরুণ প্রজন্ম যদি এখনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বদ্ধভূমি ও স্মৃতি স্তম্ভ সম্পর্কে না জানতে পারে তাহলে আগামীতে সব স্মৃতি মুছে যেতে পারে।
যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও খলিল বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নাজিমউদ্দীন কলেজ থেকে ৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গিয়েছিলাম। তখন সবাই ছিলাম ছাত্র। একত্রে ১৬৫ জন ৩ রাত ৩ দিন পায়ে হেঁটে ও নৌকায় ভারত যাই। আমাদের নেতৃত্ব দেন রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন কর্নেল শওকত আলী। তখন মাদারীপুর মহকুমার মধ্যে শরীয়তপুরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের ১৮ তারিখ যুদ্ধের জন্য মাদারীপুর ফিরে এলে আমাদের দুইজন পাক-হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে। পরে আমরা ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাই এবং কেন্দুয়ার কলাগাছিয়া বাহাদুরপুর গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করি। তবে আমাদের গেরিলা যুদ্ধ করার কথা থাকলেও যে অস্ত্র দিয়েছিল তা দিয়ে করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, পাক-বাহিনী আমাদের ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এসময় ওই গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে খবর পাই পাক-বাহিনী মাদারীপুর ছেড়ে চলে যাবে। আমরা সমাদ্দারের ব্রিজ ভেঙে দেই। এরপর ৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর সমাদ্দার ব্রিজের কাছে আসলে আমাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। পরক্ষণে ১০ ডিসেম্বর ৩৬ জন পাক-বাহিনী আমার হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে আমাদের সর্ব কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন বাচ্চু শহীদ হন। এছাড়া গণহত্যায় শহীদ হওয়া ১৩৫ জনের নাম আমরা পেয়েছি। শহীদ সরোয়ার হোসেন বাচ্চু স্মরণে সমাদ্দার ব্রিজ এলাকায় স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া গণহত্যায় শহীদ স্মৃতি ধরে রাখতে বাহাদুর গ্রামে একটা বদ্ধভূমি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে শহীদদের নামের তালিকা রয়েছে।
আকাশ আহম্মেদ সোহেল/এমএএস