আ.লীগ থেকে বিএনপিতে এসেই মনোনয়ন পেলেন তারা, তৃণমূলে ক্ষোভ

দীর্ঘ ১৭ বছর মামলা, হামলা ও জেল-জুলুম সহ্য করে রাজপথে টিকে থাকা নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে বাগেরহাটে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সদ্য দল বদল করা সাবেক দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাগেরহাটের চারটি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত হলেও এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি আসনেই (বাগেরহাট-১ ও বাগেরহাট-৪) ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ নেতাদের ধানের শীষের প্রতীক দেওয়া হয়েছে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
মাত্র এক বছর আগে যারা ছিলেন আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা কিংবা ঘনিষ্ঠ সহযোগী, দল পরিবর্তনের কয়েক মাসের মাথায় তাদের হাতেই ধানের শীষ তুলে দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডা— সর্বত্রই চলছে তীব্র সমালোচনা ও ট্রল। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে ওই দুই প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ ছবি শেয়ার করে স্থানীয় বিএনপর কর্মীরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন আসন্ন নির্বাচনে ভরাডুবির।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাট-১ (ফকিরহাট-মোল্লহাট-চিতলমারী) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক কপিল কৃষ্ণ মন্ডল। তিনি একইসাথে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব এবং বাংলাদেশ অশ্বিনী সেবা আশ্রমের সভাপতি ছিলেন। তিনি চিতলমারী উপজেলার কলাতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
অন্যদিকে, বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্যজোটের সভাপতি সোমনাথ দে। রাজনৈতিক ভোল পাল্টানোর ক্ষেত্রে তিনি বেশ আলোচিত। এক সময় তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সংখ্যালঘু বিষয়ক উপদেষ্টা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলা জাপার আহ্বায়ক ছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ২০২২ সালে মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ঠিক আগে বা পরে তিনি কৌশলী অবস্থান নেন।
দেশবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগে কপিল কৃষ্ণ মন্ডল চলতি বছরের মার্চে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন অপর একটি মামলায় কারাভোগ করেছেন সোমনাথ দে। জেল থেকে বেরিয়ে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে ২০ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন কপিল ও সোমনাথ।
শনিবার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় থেকে প্রার্থী ঘোষণার পর আসন দুটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।
মোল্লা রাজু আহমেদ নামে চিতলমারীর এক বাসিন্দা লিখেছেন, তথ্যটি জানার পর থেকে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে, যতটা অসহায় বিগত ফ্যাসিস্ট আমলেও মনে হয়নি। আমাদের এ নির্বাচনী আসনে অনেক প্রবীণ-তরুন যোগ্য ত্যাগী নেতৃত্ব রয়েছে। যারা শেখ হেলালের বিরুদ্ধে নির্বাচনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তাদের মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে নমিনি করলে এ আসনের মানুষ বিপুল ভোটে ধানের শীষকে নির্বাচিত করতো। কিন্তু আজ এই নমিনেশনের খবরটি শোনার পর থেকে নিজেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত মনে হচ্ছে। সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সংগঠন করেও নির্যাতিত নিপীড়িত মজলুম মানুষগুলোকে হঠাৎ করে নিজের পরিচয় হারিয়ে রোহিঙ্গা হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে কিনা।
মো. শিমুল নামে একজন লিখেছেন, এই সেই আওয়ামী লীগের দালাল। যাকে ১ আসন থেকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। এটা মানুষ মেনে নেবে না। বিএনপির জনগণ এটা মেনে নেবে না। সারা বছর রাজপথে থেকে, সতেরো বছর ঘুমাতে পারিনি। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কত টাকার বিনিময়ে নমিনেশন পেয়েছে এটা আমাদের জানতে হবে।
শেখ ইমরান নামে একজন বলেছেন, আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদেরও দল মনোনয়ন দিয়েছে।
শরণখোলার বাসিন্দা রাসেল আহম্মেদ ফেসবুকে সোমনাথ দের ছবি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, জয় বাংলা, ধানের শীষে ভোট দিন। পোস্টের নিচে কেউ লিখেছেন, সাথে জাতীয় পার্টির স্লোগান যুক্ত করে দিন। কেউ লিখেছেন, পরবর্তী সিরিয়ালে কোনো দল আছে।
মাসুম শেখ নামের একজন লিখেছেন, বিভিন্ন দলের জল খাওয়া সোমনাথ জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ হয়ে এখন বিএনপির প্রার্থী। আগামীতে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হলেও বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকবে না।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এটিএম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে আমাদের আসলে করার কিছু নেই। তবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দীর্ঘদিন দল করে, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করার পরে অন্যদলের কেউ এসে মনোনয়ন পাওয়ায় তারা ক্ষোভে ফুঁসছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব বিষয় কেন্দ্রকে জানিয়েছি।
একই সুরে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এমএ সালাম বলেন, আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এটি কীভাবে মেনে নেবে বলেন। তারা দুজনই সুবিধাবাদী এবং শেখ হেলালের নিকটতম অনুসারী ছিলেন। সনাতন ধর্মের যদি কাউকে দিতেও হয় দল ভালো যে হিন্দু ভাইয়েরা রয়েছে তাদের থেকে দিতো, যোগ করেন তিনি। নেতাকর্মীরা সত্যিই হতাশ হয়ে পড়েছে। এছাড়া দীর্ঘ দিন রাজপথে ছিলেন জানিয়ে বাগেরহাট-২ আসনের মনোনয়নও পুনর্বিবেচনার দাবি জানান তিনি।

বাগেরহাট-১ আসনের মনোনয়নপ্রাপ্ত কপিল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, কখনো অন্য কোনো দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না। এটিই আমার প্রথম রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ মন্দিদের সভাপতি হওয়ায় নির্যাতিত হিন্দুদের অধিকার আদায়ে আমি সব সময় সোচ্চার ছিলাম। এ কারণে এমপি-মন্ত্রীদের সাথে আমার কথা বলতে হয়েছে। সেইসব ছবি দেখিয়ে এখন ষড়যন্ত্র চলছে। কেউ বলতে পারবে না, কোনো রাজনৈতিক মঞ্চে আমি বক্তব্য দিয়েছি।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটির কাগজ ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি আরও বলেন, পদ নিতে চাইলে অনেক বড় পদ আমি পেতাম, ইউনিয়ন কমিটিতে কেনো যাব। আর মামলার বিষয়টিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উচ্চ আদালত থেকে গত সপ্তাহে রুল নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

বাগেরহাট-৪ আসনের প্রার্থী সোমনাথ দে বলেন, আমি মনোনয়ন পাওয়ায় যারা চাঁদাবাজ, জুলুমকারী, নির্যাতন করে তাদের গাত্রদাহ হচ্ছে। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ তারা আমাকে সাদরে বরণ করেছে। আমি জাতীয় পার্টি করেছি, আওয়ামী লীগ করেছি, ৫ আগস্টের পর জেল খেটেছি। আমার নামে এখনো তিনটি মামলা রয়েছে। এসব জেনেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয়, দলের হাইকমান্ড আমাকে মনোনীত করেছেন। আমি নির্বাচিত হলে মোরেলগঞ্জ-শরণখোলায় কেউ এক কাপ চাও অবৈধভাবে খেতে পারবে না।
বাগেরহাট-২ (সদর ও কচুয়া) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন।
ব্যারিস্টার জাকির হোসেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ‘সম্প্রীতি বাগেরহাট’-এর চারটি আসন রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। পাশাপাশি বাগেরহাটের মানুষের পক্ষে একজন আইনজীবী হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাগেরহাট-৩ (মোংলা–রামপাল) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম।
শেখ ফরিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তিনি বাগেরহাট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
এদিকে বাগেরহাট-২ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে গতকাল সন্ধ্যায় শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে মশাল মিছিল বের করেন স্থানীয় বিএনপির একটি পক্ষ। এতে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দলের একাংশের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
মিছিলকারীরা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালামকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। বিক্ষোভকারীরা তাকে মনোনয়ন না দিলে তারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না বলেও স্লোগান দেন।
শেখ আবু তালেব/আরএআর