অযত্ন-অবহেলায় নরসিংদীর ২২ গণকবর

আজ ১২ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে সম্মিলিত মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী শহরসহ গোটা জেলা হানাদার মুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি নরসিংদীবাসীর কাছে গৌরবোজ্জ্বল ও স্মরণীয়। প্রতি বছরই দিবসটিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তবে অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে জেলার ২২টি গণকবর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নরসিংদী জেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীনে। তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে নরসিংদীকে ৩নং সেক্টরের অধীনে নেয়া হলে কামান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. নুরুজ্জামান। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ই.পি.আর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে শত শত যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পর শুরু হয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও চোরাগুপ্তা হামলা।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন পাঁচদোনা বধ্যভূমি
এ সময় শিবপুর,পাঁচদোনা, রায়পুরাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে খণ্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয়। স্থলপথে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী মুক্ত হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন ১১৬ জন। যার মধ্যে নরসিংদী সদরের ২৭ জন, রায়পুরায় ৩৭ জন, মনোহরদীর ১২ জন, পলাশে ১১ জন, শিবপুরের ১৩ জন ও বেলাব উপজেলার ১৬ জন রয়েছেন।
এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষী অনেক গণকবর রয়েছে নরসিংদী জেলাজুড়ে। শিলমান্দি মাছিমপুর বিল, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন পাঁচদোনা ব্রিজের নিচে ,মনোহরদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীর, রায়পুরার মেথিকান্দা রেল স্টেশনের পাশে, শিবপুরের ঘাসিরদিয়াসহ পুরো জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মোট ২২টি গণকবর। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হলেও অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে গণকবরগুলো। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে করে এখনও ভয়ে আঁতকে ওঠে নরসিংদীবাসী।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে নরসিংদী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। বর্তমান জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫-৩০ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটক রাখা হতো। নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন একটি পুলের নিচে। সেখানে ৫-৬ জনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২৪-২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। পরে লোহারপুলের নিচে সবাইকে একসঙ্গে মাটিচাপা দেয় তারা।
নরসিংদী জেলা প্রশাসন কার্যলয় সংলগ্ন স্মৃতিফলক
নরসিংদী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও সেক্টর ৭১ এর সভাপতি আব্দুল মোতালিব পাঠান বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে শত শত নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। গণকবরগুলোর বেশির ভাগই চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন যদি এই স্থানগুলোতে ভিস্তিপ্রস্তর বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যায় তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছে এখানকার ইতিহাস সহজেই তুলে ধরা যাবে।
একই দাবি অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও। সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম বলেন, এই গণকবরে আমাদের সতীর্থরা শুয়ে আছে। প্রতিটি কবরে ১০-১৫ জন করেও মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। আমরা চাই এগুলো সংরক্ষণ করা হোক।
এ বিষয়ে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বলেন, বধ্যভূমিগুলো অযত্ন ও অবহেলায় থাকবে না। বর্তমান সরকার এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে খুবই আন্তরিক। এরই মধ্যে বেশ কিছু বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকিগুলো বরাদ্দের অপেক্ষায় রয়েছে।
আরএআর