সাতক্ষীরায় কাঁদছে নিম্ন আয়ের মানুষ, মিলছে না সহায়তা

করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। লকডাউনে থমকে গেছে তাদের রোজগারের পথ। জীবিকার তাগিদে লকডাউন উপেক্ষা করে রাস্তায় গেলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা, দেওয়া হচ্ছে মামলা। পরিবারের উপার্জন একমাত্র অবলম্বন গাড়িটিও আটক করছে পুলিশ। এতে কান্নার রোল পড়েছে জেলার ৭০৬ নিম্ন আয়ের পরিবারে।
তবে প্রশাসন বলছে, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি সিদ্ধান্তে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে নিম্ন আয়ের মানুষদের সহায়তাও করা হচ্ছে। তবে নিম্ন আয়ের এসব মানুষদের অভিযোগ, লকডাউনের মধ্যে পড়ে উপার্জন হারিয়ে আটকা পড়া মানুষদের মিলছে না কোনো সরকারি সহায়তা। পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ জুন থেকে সাতক্ষীরা জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল। চতুর্থ পর্যায়ে সাত দিন করে সময় বর্ধিত করে আজ সোমবার (২৮ জুন) লকডাউন চলমান রয়েছে। সাধারণ মানুষ ও যান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ রয়েছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটার জন্য দোকানপাটগুলো দুপুর ১২টা পর্যন্ত খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।

ইজিবাইক চালক, মোটরভ্যান চালকরা জানান, করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের জন্য সরকারিভাবে বর্তমানে কোনো ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি। আমরা না খেয়ে মরছি। কেউ খোঁজ রাখে না। আমাদের খাদ্য দিলে ঘর থেকে বের হব না। গাড়ি আটক করে রেখেছে। এখন খাব কী?
সাতক্ষীরা শহরের পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার বৃদ্ধ ভ্যানচালক জিয়াদ আলী জানান, আমার ভ্যানটি আটকে রেখেছে। আট দিন বসে আছি, আয়রোজগার নেই, বাড়ির কারও মুখে খাবার দিতে পারছি না। কোনো সাহায্য পাচ্ছি না। কী করব? আমি আর ভ্যান চালাব না, কিন্তু বিকল্প একটা উপায় করে দিক।
শুধু জিয়াদ আলী নন, তার মতো অনেকেই আয়রোজগার না করতে পেরে দিশেহারা। তারা বলছেন, সরকার তাদের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করেই বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে, তাহলে আমাদের মতো নিম্ন শ্রেণির কআ সরকার ভাবছে কোথায়? বারবার বলছে সহায়তা দিচ্ছে, কিন্তু তা তো আমাদের কাছে এসে পৌঁছে না।
এদিকে লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা সদরসহ উপজেলাগুলোয় মাঠে রয়েছে পুলিশ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যারিকেড। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা পরিচালনা করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
জেলায় ৫ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত মোটরভ্যান, ইজিবাইক ও মাহেন্দ্র গাড়ি জব্দ করা হয়েছে ৭০৬টি। মামলা দেওয়া হয়েছে ৪৫০টি ও ট্রাফিক পুলিশ জরিমানা আদায় করেছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে, ২৭ জুন পর্যন্ত লকডাউনের বিধিনিষেধ প্রতিপালনে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সাতটি উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেছেন ১৭৭টি। এসব অভিযানকালে মামলা দেওয়া হয়েছে ৮৪৩টি ও জরিমানা আদায় হয়েছে ৮ লাখ ৮ হাজার ৮০০ টাকা।
এসব অভিযান দোকানপাট খোলা রাখা, বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বাইরে বের হওয়াসহ নানা কারণে এ মামলা ও জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ মোট জরিমানা আদায় করেছে ২৩ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ টাকা।
সাতক্ষীরা জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ (ওসি) কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমান পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলা সদরে ২০৬টি নছিমন, করিমন, মোটরভ্যান, ইজিবাইক আটক করা হয়েছে। এসব যানবাহন ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৫০টি। জরিমানা আদায় হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা।
এ ছাড়া জেলার আটটি থানায় আরও পাঁচ শতাধিক গাড়ি আটক রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেওয়া লকডাউন স্বাভাবিক হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এসব গাড়ির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. ইয়ারুল হক ঢাকা পোস্টকে জানান, গত ৩১ মে প্রতিটি ইউনিয়নে কোভিড পরিস্থিতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের সহায়তার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে আড়াই লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৭ জুন আরও এক লাখ টাকা করে ইউনিয়ন প্রতি বরাদ্দ করা হয়েছে। তা ছাড়া জরুরি খাদ্যসহায়তা পেতে সরকারি ৩৩৩-এ কল দিলেও আমরা সহায়তা করছি। এ পর্যন্ত ১৩০ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে জানান, করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় গত ৫ জুন থেকে জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এই কোভিড পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাদের জন্য ৪০ লাখ টাকার একটি বরাদ্দ পেয়েছি। উপজেলাভিত্তিক সেগুলো বণ্টন করে বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কিছু টাকা অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলো দ্রুত বিতরণ করা হবে। বিশেষ করে যারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, কর্মহীন মানুষ, তাদের যথাযথ সহায়তাটুকু পৌঁছে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এ ছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা নগদ ও ভিজিএফ ১২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৭০ লাখ টাকা বণ্টন করা হবে। কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের প্রতি সরকার যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আমরা সচেষ্ট রয়েছি, কেউ যেন বঞ্চিত না হয়।
আকরামুল ইসলাম/এনএ