হামার স্বপ্ন একন স্রোতে ভাসিচ্চে

‘ওই জাগাত হামার ঘর আছিল, বাড়ির চারদিকে আছিল নানান জাতের ফল ও কাঠের গাছ, বাঁশঝাড় ভরা আছিল তরলা আর মাকলা বাঁশ। ওই বাড়ি হামার বাপ দাদার বাড়ি। ওটি হামার বাবা-মার কবর, হামার দাদার কবর, হামার কয়েক গোষ্ঠীর কবর। ওটি হামি বড় হছি, হামার ছোলগুলে বড় হছে। কতই না স্মৃতি হামার বুকের মদ্যে। দেকেন বাবা ওটি একন গহীন পানি। হামার স্বপ্ন একন স্রোতে ভাসিচ্চে। সব কাড়ে নিছে, সব কাড়ে নিছে এই সব্বনাইশে যমুনা।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ (৪৫)। তিনি এখন এক মেয়ে ও চার ছেলেকে নিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
গত কয়েকদিন ধরেই কামালপুর ইউনিয়নের রৌহাদহ, ইছামারা, গোদাখালী এবং সদরের চরবাটিয়ার কয়েক কিলোমিটার জুড়ে দেখা দিয়েছে যমুনার ভাঙন। এতে যমুনা তীরবর্তী মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর ফলে হুমকির মুখে রয়েছে কুতুবপুর ইউনিয়নের ধলিরকান্দি হতে রৌহাদহ পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ। রাস্তাটির বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোটবড় অনেক ফাটল। ধসে যাচ্ছে এটিকে রক্ষাকারী সি সি ব্লক। বেড়িবাঁধটি ভেঙে গেলে প্লাবিত হবে পূর্ব বগুড়ার চারটি উপজেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রাম। তলিয়ে যাবে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল। পানিবন্দি হবেন লাখো জনতা।
এসব অঞ্চলের মানুষেরা তাদের বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। টিন খোলা, খুঁটি দেওয়া, পরিবহনসহ ভাঙা আর গড়ার কাজে তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাটির চরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন।
নদী তীরবর্তী বাসিন্দা রশিদ ফকির, শাব্দুল হাকিম, রহিম আলী ও রমজান আলী জানান, যমুনা নদীর কয়েকটি পয়েন্টে গত তিন মাসের মত ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বেশি ভাঙতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলেছে। যা কোনো কাজে আসেনি। কিছু দায়সারাভাবে কয়েকটি জিও ব্যাগ ফেলে গেছে। তবে ভাঙন রোধে সহায়ক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এভাবে যদি ভাঙতে থাকে তবে কয়েক কিলোমিটার ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাবে।
কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেদাইতুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়ন প্রতি বছর ভাঙতে ভাঙতে যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে বর্ষা মৌসুমে। তারা যদি শুষ্ক মৌসুমে কাজ করতো তাহলে আমরা নদী ভাঙন থেকে অনেকটাই রেহাই পেতাম। শুষ্ক মৌসুমে কাজ হলে এই এলাকার মানুষ ভাঙন থেকে রক্ষা পেত।

বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যায় সারিয়াকান্দিতে দায়িত্বে থাকা গেজ রিডার পরশুরাম জানান, বুধবার (১৫ জুলাই) পর্যন্ত মথুরাপাড়া স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী যমুনা নদীতে পানির উচ্চতা ছিল সন্ধ্যা ৬টায় ১৫.৫৮ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ১ মিটার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে বাঙালি নদীর শিমুর বাড়ি স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৪.৫২ সেন্টিমিটার যা বিপদসীমার ৩ মিটার ৭১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত কয়েক বছরে সারিয়াকান্দি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ধরবন্দ, মানুরপাড়া, অন্তারপাড়া, রাধিকানগর কুমার পড়া, নিজ তিত পড়ল, ধাপ, দীঘলকান্দি, নবাদরী, ধনতলা, হাটশেরপুর ইউনিয়নের শেরপুর, দিঘাপাড়া, খোর্দবলাইল, হাসনা পাড়া, কুতুবপুর ইউনিয়নের অর্ধেক, কামালপুর ইউনিয়নের রৌহাদহ, ফকিরপাড়া এবং চন্দনবাইশা ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া, নৌলাপাড়া, শাকদও, আটবাড়িয়া, চর চন্দনবাইশা, নিজ চন্দনবাইশা, পাড় চন্দনবাইশা, ঘুঘুমারীর একাংশ ও আকন্দপাড়া গ্রামের হাজার হাজার পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। তাদের বেশির ভাগ আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে। কেউবা বসতি গড়ে তুলেছেন ভিন্ন অঞ্চলে।
বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছর কামালপুর ইউনিয়নের ভাঙন কবলিত এলাকার ৩০০ মিটারে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। এ বছর ৩০ মিটারে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। যমুনা খরস্রোতা নদী। যমুনা ও বাঙালি নদীতে গত কয়েকদিন ধরেই পানি কমতে শুরু করেছে। যমুনার পানি কমতে শুরু করায় কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
সাখাওয়াত হোসেন জনি/আরএআর