বাজেট-পদ সৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জের মুখে উপাচার্য, কবে চালু পুরোদমে?

দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নির্মিত দেশের স্বাস্থ্যসেবায় এক আশা-আকাঙ্ক্ষার নাম বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠালগ্নে বলা হয়েছিল— বিশ্বমানের এই হাসপাতাল চালু হলে রোগীদের আর বিদেশ যেতে হবে না। দেশেই মিলবে কম খরচে ভোগান্তিহীন চিকিৎসাসেবা। তবে, উদ্বোধনের তিন বছর পার হলেও নানা সংকটের কারণে এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু হয়নি। ফলে যে উদ্দেশ্যে হাসপাতালটি করা হয়েছিল, সেই সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম এসব সংকটের বিষয় স্বীকারও করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, পদ সৃষ্টি না হওয়া, নিয়োগ নীতিমালার অভাব, হাসপাতাল পরিচালনার নীতিমালা না থাকা এবং বাজেট বরাদ্দ না পাওয়া— এই চার বাধা কাটিয়ে উঠতে না পারলে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা সম্ভব নয়। যদিও রেডিওলজি ও ল্যাবরেটরি সেবা চালু আছে এবং সিটি স্ক্যানসহ কিছু ইনডোর সেবাও দেওয়া হচ্ছে। তবুও মন্ত্রণালয় থেকে পদ সৃষ্টির অনুমতি এবং আলাদা বাজেট না মেলায় বহুল প্রতীক্ষিত হাসপাতালটির কার্যক্রম একরকম স্থবির হয়ে আছে।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোর সেবা, অনলাইন সিস্টেম, গবেষণা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ওষুধ ও পরীক্ষার ব্যয় কমানোর প্রচেষ্টাসহ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : কয়েকদিন ধরে আউটডোরে ঘুরেছি। প্রচুর রোগী এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমরা তো অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করেছি। তারপরও রোগীদের ভোগান্তি কেন কমছে না? এটার জন্য কি মেডিকেল অফিসার সংকট কোনোভাবে দায়ী?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : আমাদের এই হাসপাতালটা মূলত রেসিডেন্ট বেসড। যেহেতু আউটডোর আমাদের এই শিক্ষা কার্যক্রমের একটা অংশ এবং বলা যায় যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একজন চিকিৎসক তার জীবনের বেশিরভাগ সময় দেন চেম্বারে বা আউটডোরে। আমাদের এখানে যে রেসিডেন্টরা আসছেন, তাদেরকে আউটডোরে ট্রেন্ড আপ করা গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আমরা যেটা ট্রান্সফর্ম করেছি সেটা হলো, আউটডোরে সার্ভিসের জায়গাটাকে আমরা বলেছি আউটডোর উইল বি একাডেমিক পার্ট। এখন আমাদের আউটডোরে প্রতিদিন শিক্ষকরা যান। আমাদের রেসিডেন্টরাও যান। ইভেন বৈকালিক আউটডোরেও আমাদের রেসিডেন্টরা যাচ্ছেন। তাহলে আমরা পুরোটাই শিফট হয়ে গেছি।
আগে ছিল শুধুমাত্র সার্ভিস অরিয়েন্টেড। এখন আমরা হচ্ছি একাডেমিক অরিয়েন্টেড, ট্রেনিং অরিয়েন্টেড। এতে আমাদের ফ্যাকাল্টিদের পার্টিসিপেশন বেড়েছে এবং রেসিডেন্টদের পার্টিসিপেশনও বেড়েছে। আমাদের কিছু সংখ্যক চিকিৎসকের পদ খালি থাকার পরও এটা আমরা ওভারকাম করতে পেরেছি।
আর আপনারা যেটা বলছেন, আমাদের অনলাইন সার্ভিসটা আস্তে আস্তে বাড়াচ্ছি। তার কারণ হচ্ছে, আমাদের অনেক রোগী আছেন যারা অনলাইনে এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে অভ্যস্ত না। ফলে ইনিশিয়ালি আমরা এখনো সেই এক্সপেক্টেড রেজাল্ট পাইনি। তবে, এটা আমরা পাব। কারণ, এর মধ্যে এখানে পেমেন্টটাও চালু হয়েছে। পেমেন্টটা এখন ওখান থেকে দিয়ে এসে এখানে এসে রসিদটা প্রিন্ট করবে। এরপর আমরা যখন প্রেসক্রিপশনটা তাকে সফটওয়্যারে দিয়ে দেব, তখন এই পার্টিসিপেশনটাও বাড়বে। আমাদের যে সময়টা গেছে এটাকে আমরা বলব ট্রানজিশন। এটা দিনে দিনে আরো বাড়বে, আশা করছি।
ঢাকা পোস্ট : আগে যারা হাসপাতালটির আউটডোরে কাজ করতেন, তারা সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে শিক্ষক হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। ওই জায়গায় (মেডিকেল অফিসার) তো একটা শূন্যতা আছে। নতুন করে নিয়োগের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : এই মুহূর্তে সেখানে নিয়োগের ব্যাপারে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ, আমরা আসার পর এই হাসপাতালে সেবার ব্যাপারে একটা পলিসিগত পরিবর্তন এনেছি। রোগীর সার্ভিসের জায়গাটাকে আমরা একাডেমিক আউটডোরে রূপান্তর করছি। এটা আমরা আমাদের রেসিডেন্ট দিয়ে ওভারকাম করতে পারছি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী যারা মেডিকেল অফিসার থেকে পার্সোনাল প্রমোশন পেয়েছেন, এই পোস্টগুলো তো খালি হয়নি। এই পোস্টগুলোতে তারাই রয়ে গেছেন। কিন্তু উনি আগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করতেন, উনি এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। সে কারণে যে হারে মনে হয়েছে পোস্ট খালি হয়েছে, আসলে সেই হারে হয়নি। কারণ, উনি এই পোস্টটার এগেইনস্টে আছেন।
ঢাকা পোস্ট : উনারা (পদোন্নতি পাওয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর) কি আউটডোরে এখনও সেবা দিচ্ছেন?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : তারা এখন সরাসরি আউটডোরে সেবা দিচ্ছেন না। তবে, তারা এখন টিচার হিসেবে পার্টিসিপেট করছেন।
ঢাকা পোস্ট : তাহলে তো আউটডোরে পদ ফাঁকা হওয়ার কথা নয়?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত পদোন্নয়ন। যে কারণে এটা ব্যক্তির পদোন্নয়ন হবে। উনি মেডিকেল অফিসার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হবেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থেকে প্রফেসর হবেন। কিন্তু অফিশিয়ালি পোস্ট ব্যবহার হবে আগেরটাই। সব বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়মেই চলে।
ঢাকা পোস্ট : সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল এখনো চালু করতে পারছেন না। কিছুদিন আগে ডাক্তাররা এখানে মানববন্ধন করেছেন, আন্দোলন করেছেন। এটা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : আমরা দায়িত্বে আসার পর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল আংশিক চালু করতে পেরেছি। আমাদের রেডিওলজি পুরোদমে চালু আছে। ল্যাবরেটরি চালু আছে। আমাদের ইনডোরের অংশবিশেষ চালু আছে। এটার জন্য আমাদের যে পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল, এই পদের অনুমোদন আমরা মন্ত্রণালয় থেকে পাইনি। অর্থাৎ এই পদের বিপরীতে কোনো বাজেট বরাদ্দ এ বছর আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। অতীতে একবার এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এবার এই বিশ্ববিদ্যালয়কে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে সুপার স্পেশালাইজড ছাড়া। এখন আমাদের ইনকাম দিয়ে আমরা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালকে সাপোর্ট দিচ্ছি। তাহলে পদ সৃষ্টি, নিয়োগের নীতিমালা, হাসপাতাল পরিচালনার নীতিমালা এবং পরিচালনার বাজেট— এই চার সংকটে পড়ে আমরা এটাকে উত্তরণ করতে পারছি না।
আমরা চেষ্টা করছি সমন্বয় করার জন্য। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এরকম একটা হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষেত্রে অতীতে আমাদের হাসপাতাল পরিচালনা পদ্ধতি আর এই পরিচালনা পদ্ধতিটা ভিন্ন। এটার যেমন একাডেমিক প্রয়োজন আছে, ফাইন্যান্সিয়াল সমন্বয়েরও প্রয়োজন আছে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা এটা করেছেন, এই সমন্বয়ের জায়গা আমরা শেষ করতে পারিনি। তবে, আগে মোটেও ছিল না। এখন আমাদের এখানে অপারেশন হচ্ছে রেগুলার, সিটি স্ক্যান হচ্ছে এবং রোগীও ভর্তি হচ্ছে। ম্যানপাওয়ার নিয়োগ করার জন্য পোস্ট ক্রিয়েশনের অনুমতি এবং বাজেট পেলেই আমরা এটা শুরু করতে পারব।
ঢাকা পোস্ট : বলা হচ্ছে, কোনো একটা পক্ষ চাচ্ছে না এখনই শূন্যপদে নিয়োগগুলো হোক। আপনি কি তাদের উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : এই বিষয়ে আমার কথা বলাটা ঠিক হবে না। আমি কিছু বলতেও চাচ্ছি না।
ঢাকা পোস্ট : আপনার তো উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় এক বছর হতে চলেছে। এই এক বছরে নিজেকে কতটুকু সফল বলে মনে করেন। অর্থাৎ কী কী করতে পেরেছেন?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : আমরা এই এক বছরে অনেক কিছুই করেছি, যা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার-প্রচারণায় আনিনি। আমরা চেয়েছিলাম কাজ করে দেখাতে, যেন মানুষ দেখেই বুঝতে পারে আমরা কতটুকু করতে পেরেছি। দায়িত্বের শুরুতেই আমরা ১০০ ইনিশিয়েটিভ নিয়েছিলাম। যেহেতু এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু আমরা গবেষণা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা— এই তিন বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করেছি। তবে, আমরা গবেষণার দিকে নজর দিয়েছি প্রথমে। গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ের কাজ শুরু করি। আপনারা দেখেছেন ইতোমধ্যে আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে একটা জার্নাল ছিল, সেটাকে আমরা স্কোপাসে ইনডেক্সড করেছি। অর্থাৎ এটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা আমাদের ৩০৭ জন রিসার্চারকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির ব্যবস্থা করেছি। এই ৩০৭ জন, যাদেরকে এখন স্কোপাসে পাওয়া যায়।
এই সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের গবেষণা খাতে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ আরো ত্বরান্বিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে আমাদের রেসিডেন্টরা অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। আমাদের শিক্ষকরাও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে প্রকাশনা, এগুলো যদি কিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়, ইউনিভার্সিটি সেই পাবলিকেশন চার্জটা দেবে— এটা আমরা ঠিক করেছি।
এছাড়া আপনারা দেখেছেন, আমরা সার্ভিসের ক্ষেত্রে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা যে এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের কাজটা শুরু করেছি, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইন্টারন্যাশনালি তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। আমাদেরকে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাকে-সহ আরেকজন ফ্যাকাল্টিকে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা একটা বড় স্বীকৃতি, বলা যায়।
আমরা রোবোটিক বেসড, এআই বেসড রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার চালু করেছি। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমরা শিক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন পর্যন্ত ১০০০-এরও বেশি ট্রেনিং আমাদের ফ্যাকাল্টিদেরকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নৈতিকতা, শিক্ষকতা ও হিউম্যান বিহেভিয়ার— এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করেছি। আমরা আমাদের প্রশিক্ষণের আওতায় ক্লিনার থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে, যেমন- আমাদের আউটডোরের এমএলএসদেরকে হিউম্যান বিহেভিয়ারের ওপর ট্রেনিং দিয়েছি। নার্সদেরটা শুরু হয়েছে। পার্শ্ব-চিকিৎসকদের আমরা মেডিকেল এথিক্সের ওপর ট্রেনিং দিয়েছি। নিউ জেনারেশনের যে টিচার, তাদেরকে এডিটরস ফোরাম, ইয়াং এডিটর ফোরাম তৈরি করে তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা এবং এগুলো মেরামতের ক্ষেত্রে আমাদের প্রশাসনিক কার্যক্রমে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্ত্বেও দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্য আমরা প্রকিউরমেন্ট ট্রেনিং শুরু করেছি এবং এরপর থেকে আমাদের প্রকিউরমেন্ট বেড়েছে। আমরা ইজিপি ট্রেনিং দিয়েছি, যাতে আমাদের এই আর্থিক ব্যবস্থাপনাটার উন্নতি হয়।
ঢাকা পোস্ট : রোগীদের ক্ষেত্রে আপনারা কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : আপনারা জানেন, এই দেশে মানুষের আর্থিক খরচের মূল জায়গা হচ্ছে ওষুধ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধের ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাজেট তিন কোটি টাকা থেকে ১২ কোটি টাকায় উন্নীত করেছি। আমরা বলেছি, কিছু কিছু ওষুধ আনলিমিটেড সাপ্লাই দেব। আমাদের দেশে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের জন্য মানুষের স্ট্রোক হয়, হার্ট অ্যাটাক হয়। ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের যে ওরাল ওষুধগুলো, এগুলো আমরা আনলিমিটেডভাবে ইনডোরে সাপ্লাই দিচ্ছি। প্রাথমিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ইনডোরে আনলিমিটেড সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে হাসপাতাল ইনফেকশন কন্ট্রোল। আমাদের দেশে হাসপাতাল ইনফেকশন কন্ট্রোল করতে পর্যন্ত কোনো কাজ হয় না। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সঙ্গে আমরা জয়েন্ট ভেঞ্চারে ইনফেকশন কন্ট্রোল সিস্টেমের কাজ শুরু করেছি এবং আমাদের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে আমরা পর্যাপ্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার, যেটা ইনফেকশন কন্ট্রোলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো হাসপাতালের ইনডোরে আনলিমিটেড সাপ্লাই নিশ্চিত করেছি। আমরা আইসিইউ ও পোস্ট অপারেটিভে দামি ওষুধগুলো অ্যাভেইলেবল করেছি। আউটডোর সার্ভিসটাকে উন্নত করার জন্য আমরা ওখানেও ইনফেকশন কন্ট্রোল, কিউ ম্যানেজমেন্ট এবং ক্লিনলিনেস (পরিচ্ছন্নতা) অতীতের যেকোনো সময়ের চাইতে উন্নত করেছি।
এছাড়া আমরা একটা রোগী ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করেছি। এখন থেকে রোগীরা আমাদের চারটা পয়েন্টে সংক্ষিপ্ত একটা ফিডব্যাক দেবেন। আমরা ইতোমধ্যে দেড় হাজার রোগীর ফিডব্যাক নিয়েছি। আমরা খুবই আশ্চর্য হয়েছি, আগের চাইতে রোগীদের স্যাটিসফ্যাকশনের হার বেড়েছে। আমরা এটা নিশ্চিত করেছি, সার্ভেতে যাতে কোনোপ্রকার ইনফ্লুয়েন্স না হয়, সেজন্য আমরা বাইরের লোকদের দিয়ে এই সার্ভের কাজ করিয়েছি। এমনকি কিউআর কোড আমরা ওয়ালে ওয়ালে লাগিয়ে দিয়েছি। যেন সচেতন লোকেরা ইন্ডিপেন্ডেন্টলি এটা করতে পারেন।
আমাদের রেডিওলজি বিভাগ, যেখানে সার্ভিস নিতে মানুষকে অনেক লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এটা আমরা ১০০% অনলাইন বেসিস করে ফেলব। ইনডোরে আমাদের যে ল্যাবরেটরি সার্ভিস, সেখানে কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটি— দুটোরই উন্নতির জন্য আমরা প্রথমে একটা কমিটি করে আনরেজিস্টার্ড মেশিনগুলো এখান থেকে বের করে দিয়েছি। মানে ইন্টারন্যাশনাল রিকগনাইজড, ইউএসএফডি, ডিজিডি অ্যাপ্রুভড মেশিন আমরা এখন ব্যবহার করে থাকি। অর্থাৎ পুরো ল্যাবরেটরি সিস্টেমকে অ্যাক্রেডিটেশন পাওয়ার জন্য আমাদের কাজ চলছে এবং সবগুলো ডিপার্টমেন্ট একযোগে কাজ করছে। এটা ইন্টারনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স, এক্সটারনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স— এই জায়গাগুলোতে আমরা পার্টিসিপেট করছি। যাতে করে এই সার্ভিসটা আরো উন্নত হয়। আবার আমাদের এই সার্ভিসগুলোকে টাইম টু টাইম অ্যাসেস করে আমাদের স্ট্যান্ডার্ডকে অন্য দেশের স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে মিল করার জন্য আমরা মেডিকেল অডিট সিস্টেম চালু করার চেষ্টা করছি। যাতে ওদের কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট হয়।
ঢাকা পোস্ট : আপনারা সাম্প্রতিক সময়ে একাডেমিক কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, বিশেষ করে ক্লাসরুম ডিজিটালাইজেশন, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথ কনফারেন্স— এসবের প্রভাব কীভাবে দেখছেন? বাংলাদেশে স্বাস্থ্যশিক্ষায় এর বাস্তব পরিবর্তন কতটুকু?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : আমাদের একাডেমিক কার্যক্রমে আরো বেশি ইন্টারন্যাশনাল কোলাবরেশন বাড়ানোর জন্য ক্লাসরুমগুলোকে ডিজিটালাইজ করছি। যাতে ক্লাসের সময় আমাদের বাংলাদেশি যারা বিদেশে আছেন, স্পেশালিস্ট ও ইন্টারন্যাশনালি যারা রিনাউন্ড, তারা আমাদের এখানে ক্লাসে পার্টিসিপেট করতে পারেন। এটার ভালো ইফেক্ট আমরা পেয়েছি। আমরা দেখেছি, আমাদের এই প্যাথোলজি কনফারেন্সে রয়্যাল কলেজ অব প্যাথোলজির সঙ্গে আমরা যৌথভাবে এবারের কনফারেন্স করেছি। ওরা আমাদেরকে কনফারেন্সের সিএমই ক্রেডিট অ্যাক্রেডিটেশন দিয়েছে। এটা বাংলাদেশে ফার্স্ট টাইম। আজ আমরা যে প্রোগ্রামটা করছি, নিউরোলজির সঙ্গে ওয়েস্টার্ন-এর, এটা ওয়ার্ল্ডের একটা অর্গানাইজেশন যারা নিউরো ইন্টারভেনশনে কাজ করে। প্রতিদিনই আমরা দেখেছি, এই কাজগুলো মানে সাইন্টিফিক ব্যাকগ্রাউন্ডে ভিজিবল হয়। প্রচুর প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে কোলাবোরেট করার জন্য রেগুলার আসছে। অলমোস্ট এভরি ডে আসছে। এটা সিঙ্গাপুর থেকে আসছে, ইউকে থেকে আসছে, চায়না থেকে আসছে, পাকিস্তান থেকেও আসছে। প্রচুর জায়গা থেকে আমরা রেসপন্স পাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট : আমরা জানি, বিএমইউকে সরকার প্রতি বছর একটা বরাদ্দ দেয়। সেই প্রেক্ষিতে সাধারণ রোগীদের প্রতি আপনাদের কোনো দায়বদ্ধতা আছে কি না? যদি থাকে তাহলে সেই অবস্থান থেকে আপনারা কী করেন?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : অফকোর্স আছে। এই দায়বদ্ধতা থেকে তো আমরা অ্যানালাইসিস করে দেখলাম যে রোগীদের ব্যয়ের অন্যতম একটা অংশ হচ্ছে ওষুধ। সেটার জন্য আমরা বাজেট তিন কোটি থেকে ১২ কোটি টাকায় নিয়েছি। রোগীদের আরেকটা ব্যয় বৃদ্ধির জায়গা হচ্ছে ইনফেকশন। হাসপাতালে আসলে ইনফেকশন হয়। ইনফেকশন কন্ট্রোলের জন্য আমরা পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে ফ্লোর ক্লিনিং ও ওয়ার্ড ক্লিনিং— এগুলোতে পর্যাপ্ত ইনভেস্ট করছি।
আমরা যেমন ইনফার্টিলিটির মূল্য হ্রাস করেছি, এমন আর কোথায় কোথায় মূল্য হ্রাস করা যায়, সেটার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এটা সামনে আরো দৃশ্যমান হবে বলে আশা করি।
ঢাকা পোস্ট : যারা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের নাকি প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। এটা যদি সিনিয়রদের থেকে নবীন চিকিৎসকদের শেখার একটা প্রক্রিয়া হয়, তাহলে কী পরীক্ষাগুলো বিনামূল্যে করার সুযোগ আছে কি না এবং এটা নিয়ে আপনাদের কোনো প্ল্যান আছে কি না?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : এখানে যে পরীক্ষাগুলো করা হয়, সেগুলোর মান অনুযায়ী আমরা স্বল্পমূল্যেই করার চেষ্টা করে থাকি। এমনকি এখানে বিনামূল্যেও কিছু পরীক্ষা হয়। সেটা অবশ্যই অনেক বেশি সংখ্যক না। আর মূল্য কমানোর বিষয়টি নিয়ে আমরা অ্যাসেসমেন্ট করছি, কোন কোন জায়গায় আমাদের মূল্য কমানোর সুযোগ আছে। সে অংশটা আমরা অ্যাড্রেস করব।
ঢাকা পোস্ট : আপনি যদি আরো একটি বছর এই দায়িত্বে থাকতে পারেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন আর কী কী দেওয়ার ইচ্ছা আছে?
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম : খুবই ভালো প্রশ্ন। প্রথমত, যেহেতু এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের প্রথম কাজ হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ, একাডেমিক ও স্বাস্থ্যসেবার মানটা আরো ইন্টারন্যাশনাল রিকগনিশন পাওয়া। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিক্রুটমেন্ট, সব ধরনের প্রেসার বা ইনফ্লুয়েন্সকে অতিক্রম করে কোয়ালিটি রিক্রুটমেন্টের ওপর জোর দেওয়া। এটা আমার একটা প্রায়োরিটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। পুরো অফিস স্টাফ ও শিক্ষকদের ভিশন দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এটা হচ্ছে বড় কাজ। ডব্লিউএইচও, জাইকা, ইউএনডিপিসহ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন যেগুলো আছে, তাদের সঙ্গে রয়্যাল কলেজের কোলাবরেশন করে একাডেমিক দিকটাকে আরো উন্নত করা। আর সার্ভিসকে ডব্লিউএইচও-জাইকার সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নত করা। বিশেষ করে জাইকার সঙ্গে অথবা কোইকাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নার্সিং সার্ভিসকে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় নিতে পারলে স্বাস্থ্যসেবায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। একইসঙ্গে আমি চাইব, পয়েন্ট অব কেয়ার হিসেবে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালকে পুরোপুরি অ্যাক্টিভ করা। এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং এটাই অগ্রাধিকারে থাকবে।
আমি যে চারটা চ্যালেঞ্জের কথা বলেছি, সেগুলোকে ওভারকাম করে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে।
টিআই/এমএআর
