পিরোজপুরে বিকশিত হচ্ছে জাহাজনির্মাণ শিল্প

বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ও ক্রমবিকাশমান শিল্প জাহাজ নির্মাণ। জাহাজ রপ্তানি করার মাধ্যমেই মূলত এই শিল্প সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একটি প্রধান প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পে পরিণত হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলায় দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে জাহাজ নির্মাণশিল্প।
এই উপজেলার বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে ছোট-বড় নানা আকৃতির জাহাজ। বানানো হচ্ছে লঞ্চ, কার্গো জাহাজ, উন্নত মানের ট্রলারসহ নানা নৌযান। এসব ডকইয়ার্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। তবে সম্ভাবনাময় এই শিল্পে শ্রমিকরা সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ পেলে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ ও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
প্রায় ৩৩ বছর আগে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও, সম্প্রতি এটি বাণিজ্যিকভাবে প্রসারিত হয়েছে। আর এর সঙ্গে যুক্ত থেকে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। কিন্তু শ্রমিকরা বলছেন, ডকইয়ার্ডে সারা দিন শ্রম দিয়েও পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি।
ভৌগোলিক কারণে পিরোজপুরের সাতটি উপজেলার চারদিকেই রয়েছে নদী। এর মধ্যে নেছারাবাদ-স্বরূপকাঠি উপজেলার সন্ধ্যা নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণের বেশ কয়েকটি ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডে কম খরচে বানানো হচ্ছে লঞ্চ, কার্গো জাহাজ, উন্নত মানের ট্রলারসহ নানা ধরনের নৌযান। তাই সাশ্রয়ী হওয়ায় জাহাজ কিনতে ও মেরামত করতে দূরদূরান্ত থেকে আসেন ব্যবসায়ী ও জাহাজ-মালিকরা।
প্রায় ৩৩ বছর আগে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও, সম্প্রতি এটি বাণিজ্যিকভাবে প্রসারিত হয়েছে। আর এর সঙ্গে যুক্ত থেকে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। কিন্তু শ্রমিকরা বলছেন, ডকইয়ার্ডে সারা দিন শ্রম দিয়েও পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি।
জানা যায়, পিরোজপুরের সন্ধ্যা নদীর দুই পাড়ে সোহাগদল, কালিবাড়ি, বরইকাঠি, বালিহারী, তারাবুনিয়া খালের পাশে ছোট-বড় ২৮টি ডকইর্য়াডে ৯ থেকে ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। একটি বড় আকারের জাহাজ তৈরিতে সময় লাগে ৯ থেকে ১০ মাস।
এ বিষয়ে শ্রমিক কালাম গাজী বলেন, সারা দিন এই কাজ করে মাত্র সাড়ে ৩০০ টাকা মজুরি পাই। শ্রমিক ছাব্বির জানান, আমরা যে কাজ করি, আর তাতে যে টাকা পাই, তাতে কি চলে? আরেকটু বেশি বেতন হলে ভালো হয়।
নির্মাণশ্রমিক রশিদ মিয়া জানান, স্বরূপকাঠী ডকে বড় বড় আন্তর্জাতিক জাহাজ তৈরি হয়। আজমীর হোসেন বলেন, আমরা এখানে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা-৪টা পর্যন্ত কাজ করি। তাতে আমাদের সারা দিনের হাজিরা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। বেতন আরও বেশি হলে আমাদের পরিবার নিয়ে আমরা ভালো থাকতে পারতাম।
বাংলাদেশে জাহাজনির্মাণশিল্পে যে কাজগুলো হয়, তাতে শ্রমিকদের যে নিরাপত্তা দরকার, সেই নিরাপত্তার নেই তেমন কোনো সঠিক পরিকল্পনা। শ্রমিকরাও অভিযোগ করে জানান, তারা ঝুঁকিমুক্ত কোনো সুবিধা পান না। তাই অনেক শ্রমিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
এ নিয়ে শ্রমিক রহমত আলী বলেন, বলা চলে, আমরা কাজ করি অনেক রিস্কের ওপর। আমরা যখন কাটিং বা ওয়েল্ডিং করি, তখন সৃষ্ট আগুন আমাদের গায়ে ও মাথায় পড়ে সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আসলে সেফটি না থাকায় আমরা অনেক কষ্টে কাজগুলো করি।
শ্রমিক কামরুল ইসলাম বলেন, আমাদের নিরাপত্তার অনেক অভাব। হেলমেড নেই, হ্যান্ড গ্লাবস নেই। যে পরিমাণ বেতন, তাতে চলতে খুব কষ্ট হয়। রং-মিস্ত্রি আব্দুর রশিদ বলেন, আমাদের এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা কোনো রকম আছে। আমরা রং করি বলে আমাদের ওইভাবে কোনো পোশাকও দেওয়অ হচ্ছে না।
ডকইর্য়াডগুলো আরও উন্নত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ডকইয়ার্ডের শিল্প আরও বিস্তৃতি লাভে কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নেছারাবাদ জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সরকার জাহাজ নির্মাণের জন্য এই উপজেলায় একটি প্রতিষ্ঠান করবে বলে জানিয়েছে।
মো. মোশারফ হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার পরও নেই উন্নত মানের কোনো বেতন-সুবিধা। তাই ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্মাণশ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা যে কাজ করি, তাতে আমাদের বেতন অনেক কম। আমাদের সংসার চলে না। মজুরি কম আবার এসব কাজে ঝুঁকিও রয়েছে অনেক। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেই তেমন কোনো ব্যবস্থা।
ডকইয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আমরা যদি সরকারি সহযোগিতা পাই এবং আমরা যদি একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাই, তাহলে আমরা বিশ্বমানের জাহাজ নির্মাণ করতে পারব।
এ ব্যাপারে ডকইয়ার্ডের মালিক সোবাহান কাজী ঢাকা পোস্টকে জানান, এখন বিদ্যুতের সমস্যা না থাকলেও গরম ও বৃষ্টির সময় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় শ্রমিকদের। শুধু অভিজ্ঞতা নয়, সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা প্রশিক্ষণ পেলে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজও তৈরি করতে পারবেন তারা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ডকইর্য়াডগুলো আরও উন্নত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ডকইয়ার্ডের শিল্প আরও বিস্তৃতি লাভে কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নেছারাবাদ জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সরকার জাহাজ নির্মাণের জন্য এই উপজেলায় একটি প্রতিষ্ঠান করবে বলে জানিয়েছে। ইতিমধ্যে জায়গা খুঁজে নির্ধারণ করার জন্য মাঠ প্রশাসনকে বলা হয়েছে। আমরা চেষ্টায় আছি যত দ্রুত সম্ভব শিল্পটিকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য।
এনএ