পানি কমলেও বিপদ কাটেনি তিস্তাপাড়ের মানুষের

‘দুই দিন থাকি নদীত পানি কমছে। কিন্তুক বিড়ম্বনা কমে নাই। নদী ভাঙতে আছে। এ্যলাও নিচ্যা জাগাত (নিম্নাঞ্চল) হাঁটুপানি। এমন অবস্থাত থাকা দায়। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়্যা (নিয়ে) বেশি যন্ত্রণা। আবাদি জমি পানিত তলে আছে। আমনের খেত নষ্ট হইছে, আর আবাদ হবার নায়। এ্যলা তো দেওয়া ম্যাঘ (আকাশ অন্ধকার) করলে ভয় নাগে। টানা ঝড়বৃষ্টি হইলে বানোতে সোগ (বন্যায় সব) ভাসি যাইবে।’
পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাওয়ার পথে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সালমা বেগম। তিনি থাকেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা চরে। সোমবার (২৩ আগস্ট) সকালে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে তিস্তার ভাঙন পরিস্থিতির কথা জানান ওই নারী।
সামলা বেগমের ভাষ্য, নদীর পানি কমলেও ভাঙন কমেনি। এখনো হাঁটুপানিতে রাস্তা-ঘাট, আবাদি জমিসহ ধান ও পাটের খেত তলিয়ে আছে। এছাড়া তিস্তার পানি গ্রামে ঢুকে পড়ায় কয়েক হাজার মানুষ পরিবার নিয়ে পানিবন্দি রয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীনও হয়েছে। এ কারণে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়েছেন।

এদিকে গেল কয়েকদিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানিতে টইটম্বুর তিস্তা অববাহিকা। পানির চাপ সামাল দিতে বৃহত্তর সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাটের সব কটিই খুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিপদ কাটেনি নদীপাড়ের মানুষের।
সরেজিমনে দেখা গেছে, গঙ্গাচড়ায় তিস্তার তীরবর্তী সাত ইউনিয়নের চরসহ নিম্নাঞ্চলগুলো এখনো পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকার পানিবন্দি পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন তারা। অনেকে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ঘরের বিছানার ওপরে জিনিসপত্র রেখে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন বসতবাড়ি।
দুর্ভোগ বেড়েছে বন্দি মানুষজন বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু ও গবাদিপশুর। কোথাও কোমরপানি, আবার কোথাও হাঁটুপানি হলেও ছোট নৌকা ও বাঁশের ভেলায় ব্যবহার করে চলাচল করছেন লোকজন। পানির তীব্র সোতে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। বিনবিনা চরে বাঁধটি ভেঙে গোটা এলাকার পানি ঢুকেছে। এছাড়া পূর্ব বিনবিনা ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলীর শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, গাছপালা ও আমানের খেত কোমরপানিতে তলিয়ে আছে।
বিনবিনা, ইচলী, চিলাখাল ও মটুকপুর চরের চারিদিকে এখনো পানিতে একাকার। কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও কোমরপানি। স্থানীয়দের দাবি, এসব এলাকায় অন্তত ৩ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। কিছু কিছু জায়গাতে রাস্তা-ঘাট ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, তিস্তার বামতীরে কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনার চর থেকে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ পর্যন্ত একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। বাঁধ নির্মাণ করা গেলে হাজার হাজার একর ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, গাছপালা রক্ষা পাবে। তখন সারাবছর খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যাবে। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে এখানকার মানুষ একটি বড় ভূমিকা রাখবে। এ দাবি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরকে জানালেও কেউ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলেও অভিযোগ তিস্তাপাড়ের বাসিন্দাদের।
বিনবিনা চর এলাকার মনতাজ ও আইয়ুব আলী জানান, এবার তারা আমন চাষাবাদ করতে পারবেন না। পর পর কয়েকবার পানি বাড়ায় তাদের আবাদি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের আমনসহ ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। যতদিন পুরোপুরি পানি কমে আসবে না, ততদিন নতুন করে চাষাবাদ করা সম্ভব হবে না।

এদিকে গত শনিবার জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ও রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী তবিবুর রহমান ক্ষতিগ্রস্ত ও প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় ভাঙন রোধে জরুরিভাবে জিওব্যাগ ফেলানোসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তারা। ওই দিন কয়েক শতাধিক পরিবারকে খাদ্যসহায়তা প্রদান করা হয়।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাসলীমা বেগম জানান, নদীতীরবর্তী প্লাবিত নিম্নাঞলে পানি কমে আসছে। সেখানকার পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের অনুকূলে ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে জনপ্রতি ১০ কেজি চাল, মসুরের ডাল, সয়াবিন তেল, লবন, চিনি, মুড়ি, সেমাই, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের গাণিতিক মডেলের তথ্য অনুযায়ী আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের স্থানগুলোতে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। এর ফলে এই অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এমএসআর