রংপুরে বিদ্যুৎ যেন অমাবস্যার চাঁদ

রংপুর নগরে এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহত লোডশেডিং আর তীব্র গরমে হাপিত্যেশ করছে নগরবাসী। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের সঙ্গে কম ভোল্টেজে নষ্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক সামগ্রী। এতে ব্যাহত হচ্ছে ছোট ও মাঝারি শিল্প কলকারখানার উৎপাদন।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু গেল এক সপ্তাহেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং একই অবস্থা রংপুর নগরের বাইরের উপজেলাগুলোতেও। একবার বিদ্যুৎ গেলে তার দেখা যেন আর সহজে মিলছে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ যেন এখানে থাকে না, শুধু মাঝে মাঝে আসে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিদিন ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত রংপুর নগরের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়-সাত বার বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করছে। আর সন্ধ্যা হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকছে নগরবাসী। এভাবেই একদিন দুদিন করে গেল সাতদিন ধরে দিনে রাতে সমানে চলছে লোডশেডিং।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ দিন সমস্যা থাকলেও এক সপ্তাহের বেশি দিন বিদ্যুতের লুকোচুরি চরমে উঠেছে। কখন বিদ্যুৎ আসে, কখন যায় তার ঠিক নেই। আবার কম ভোল্টেজের কারণে বৈদ্যুতিক সামগ্রী নষ্ট হচ্ছে। গরমে ঘরে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে থাকা দায়। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে মন্দা। মার্কেটগুলোতে কমছে ক্রেতার উপস্থিতি।
শনিবার সকাল থেকে রংপুর নগরে মাইকিং করে বিদ্যুৎ বিড়ম্বনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো)। তাদের দাবি, বড়পুকুরিয়াসহ এই অঞ্চলের উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। চাহিদার ৮৫০ মেগাওয়াটের মধ্যে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে কবে নাগাদ পরিস্থিতি ভালো হবে তার সঠিক উত্তর মিলছে না কারও কাছে।
লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজ নিয়ে নেসকোর দেওয়া ব্যাখ্যায় অসন্তুষ্ট নগরবাসী। তারা বলছেন, গড়ে প্রতিদিন ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের অভাবে এমন পরিস্থিতি হতে পারে না। আগে এর চেয়ে বেশি ঘাটতি থাকলেও মানুষের দুর্ভোগ ছিল কম।
রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছাবিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে এত বেশি লোডশেডিং হচ্ছে, যা বলার মতো না। সঙ্গে তীব্র গরম তো আছেই।
পাশের এলাকা আদর্শপাড়ার শিক্ষার্থী সালমা বিনতে আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েক দিন ধরে ঠিকমতো পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছি না। এখন স্কুল খুলেছে, একটু ভালো পড়ালেখা করা দরকার। মনে হচ্ছে লোডশেডিংয়ের প্রতিযোগিতা চলছে।
নগরীর ঠিকাদারপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, ছোট কারখানায় প্লাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় উৎপাদন কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। এভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলতে থাকলে ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
কামারপাড়া ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকার মমিনুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলায় আমরা অতিষ্ঠ। ঘুমের মধ্যে দেখি বিদ্যুৎ নেই। আবার ঘুম থেকে উঠেও একই অবস্থা। সকালে বিদ্যুৎ থাকে না, দুপুরে থাকে না, সন্ধ্যায় তো কথায় নেই। আর মাঝরাতে ২-৩ ঘণ্টারও বেশি লোডশেডিং চলে। কম ভোল্টেজে টেলিভিশন চলে না, ফ্যান ঘুরলেও বাতাস নেই। ফ্রিজ নষ্টের পথে। এক দিন দুদিন হলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এভাবে প্রতিদিন তো সহ্য করা অসম্ভব।
হঠাৎ কেন এমন বিদ্যুৎ বিপর্যয়, এ প্রশ্নের জবাবে নেসকোর কর্মকর্তারা বলছেন, রংপুরে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা গড়ে ৮৫০ মেগাওয়াট। তবে সময় ভেদে কিছুটা হেরফের হয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৬০০-৭০০ মেগাওয়াট। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। ওই কেন্দ্র থেকে আগে দেড়শ মেগাওয়াট পেলেও এখন মিলছে ৭৬ মেগাওয়াট।
কর্মকর্তারা আরও জানান, রংপুরে নেসকোর তিনটি ইউনিট আছে। প্রতিটি ইউনিটে দুটি করে পাওয়ার ট্রান্সমিটার রয়েছে। শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লালবাগ উপকেন্দ্রের ৩৩/১১ কেভি ১০/১৩ এমভিএ’র একটি ট্রান্সমিটার বজ্রপাতজনিত কারণে বিকল হয়। বিবিবি-১, নেসকো লি. রংপুর দুটি ১০/১৩ এমভিএ পাওয়ার ট্রান্সফরমার দ্বারা প্রায় ৪৩ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
একটি ১০/১৩ পাওয়ার ট্রান্সফরমার বিকল হওয়ায় প্রায় ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর এ ঘাটতি একটি ট্রান্সফরমার দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রংপুর অঞ্চলের নেসকোর প্রধান প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেন সরকার বলেন, গ্রাহকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখতে ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম থেকে একটি ১৬/২০ এমভিএ পাওয়ার ট্রান্সফরমার চালু করার কাজ করছি। বর্তমানে বিকল হওয়া ট্রান্সফরমারটি অপসারণের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নতুন ট্রান্সফরমারটি স্থাপন করা হয়েছে। তবে ট্রান্সফরমার চালু করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে দু-তিন দিনের মধ্যে পাওয়ার ট্রান্সফরমারটি চালু করা হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি