সরকার থেকে কোনো দিন কিছু পাইনি!

অভাবের সংসার আর টানটানি। একা কুলাতে পারেন না মা-বাবা। তাই ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বিস্কুট কারখানায় কাজ নেন। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় থমকে যায় জীবনের গতি। মেশিনে কাটা পড়ে তার ডান হাত। কেটে যায় মাথার অর্ধেকও! এখানেই তার স্বপ্নের সমাপ্তি। জীবন হয়ে পড়ে স্থবির। মোরসালিন। বেঁচে থাকার তাগিদে তিনি এখন ভিক্ষা করেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।
মৌলভীবাজার শহরের চৌমুহনা কিংবা সেন্ট্রাল রোডে দেখা যায় হাত কাটা এই যুবককে। যে বয়সে চাঞ্চল্য থাকার কথা ছিল তার জীবনে, সে বয়সে তার হতাশা আর পরোপকার ছাড়া নিশ্চিত কিছিুই নেই। পরিবার, হাসি, আনন্দ― সবকিছু এখন তার কাছে পর। তবু মোরছালিন স্বপ্ন দেখেন মা-বাবার ইচ্ছা পূরণের।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় মোরছালিনের। তিনি বলেন, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত স্কুলে গিয়েছি। এরপর পরিবারের অভাবের কারণে বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় রোলিং মেশিনে হাত পড়ে কেটে যায়। মাথায়ও অনেক আঘাত পাই। আমার চিকিৎসার জন্য মা-বাব জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা অসহায় হয়ে পড়ে আছেন। তাই মৌলভীবাজার চলে আসি। এখানে ভিক্ষা করে টাকা জোগাই। কিছু টাকা মাসে মাসে মা-বাবাকে পাঠাই। বড় ভাই একজন আছেন, তিনিও প্রতিবন্ধী।
মোরছালিন বলেন, এখন অনেক সময় হঠাৎ মাথায় কাজ করে না। রোজ ওষুধ খেতে হয়। চাঁদনিঘাট এলাকায় একটা ভাড়া ঘরে আমি আর আরেকজন থাকি। ভিক্ষা করে প্রতিদিন যা পাই, তা দিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া করি। কী করব বলেন। আমার চিকিৎসার জন্য মা-বাবা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তাদেরও তো কিছু সাহায্য করতে হবে। কেউ কোনো সহযোগিতা করে না। সরকার থেকেও কোনো দিন কিছু পাইনি। যেদিন ভিক্ষা করতে পারি না, সেদিন না খেয়ে থাকতে হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলায় মোরছালিনের বাড়ি। তার বাবা মুজিবুর রহমান একজন দিনমজুর। পাঁচ ভাই, এক বোন নিয়ে তাদের পরিবার। এক ভাই বাকপ্রতিবন্ধী। বাকি তিন ভাই দিনমজুর। প্রবাসী-অধ্যুষিত জেলা মৌলভীবাজারে এসেছিলেন চাচার বাড়িতে। সেখানেও ঠাঁই হয়নি। তাই নিরুপায় হয়ে বেচে নিলেন ভিক্ষাবৃত্তিকে।
মোরসালিন জানান, স্থানীয় কাউন্সিলরের সহযোগিতায় মৌলভীবাজারে ভোটার তালিকায় নিজের নাম তুলেছেন। তার শেষ ইচ্ছে, সব হারিয়ে নিঃস্ব মা-বাবার জন্য কিছু করতে পারা। সরকার যদি তার দিকে একটু নজর দেয়, তাহলে বাকি জীবনটা নাহয় সবাইকে নিয়ে আনন্দ-বেদনায় কাটাল।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলায় সরকারি হিসাবমতে ২ হাজার ৭০ জন ভিক্ষুক রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ভিক্ষুকদের শতভাগ পুনর্বাসনসহ তাদের বিভিন্ন পেশায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। ভিক্ষুকদের বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভিক্ষুকমুক্তকরণে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এসে সেলাই মেশিন দেওয়াসহ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় ভিক্ষুকদের নিয়ে আসা হচ্ছে। ভিক্ষুকদের ঋণ সহায়তার মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া যুব উন্নয়নের হাঁস-মুরগি লালনপালন, সবজি চাষ ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছুটা অর্থায়নের মাধ্যমে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর মাসুদ আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিক্ষুকদের মধ্যে যারা প্রতিবন্ধী, তাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। মোরছালিনকে পুনর্বাসনের জন্য চেষ্টা করছি। সরকারি সহযোগিতা পেলে সে নতুন জীবন ফিরে পাবে। এ ছাড়া অনেক ভিক্ষুককে বিধবা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতার আওতায় আনা হবে। সে জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
মোরছালিন নামের এক ছেলে কাটা হাত ও অর্ধেক মাথা নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করছে। বিষয়টি আমি এখনই জানতে পারলাম। আমি খোঁজ নেব, সে যদি সরকারি কোনো সহযোগিতা না পায়, তাহলে তাকে জেলা প্রশাসন সহযোগিতা করবে।
মীর নাহিদ আহসান, জেলা প্রশাসক
সম্মিলিত সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ মৌলভীবাজারের সহসভাপতি এম মুহিবুর রহমান মুহিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোরছালিন নামের ছেলেটাকে শহরে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। ভিক্ষাবৃত্তি ধর্মীয়ভাবেও যেমন ঠিক না, তেমনি সামাজিকভাবেও এটি অভিশাপ। তাই রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েরই দায়িত্ব মোরছালিনের পাশে দাঁড়ানোর।
তিনি আরো বলেন, ভিক্ষুক মুক্ত মৌলভীবাজার এখন সময়ের দাবি। ভিক্ষাবৃত্তি বন্দ করতে হলে প্রতিটা গ্রামে, পাড়া, মহল্লা ও শহরে ভিক্ষুকদের তালিকা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া ভাতায় যে অর্থ দেওয়া হয়, তাতে একজন মানুষ চলার জন্য উপযুক্ত নয়। সে জন্য ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে স্থায়ী পরিকল্পনা নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোরছালিন নামের এক ছেলে কাটা হাত ও অর্ধেক মাথা নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করছে। বিষয়টি আমি এখনই জানতে পারলাম। আমি খোঁজ নেব, সে যদি সরকারি কোনো সহযোগিতা না পায়, তাহলে তাকে জেলা প্রশাসন সহযোগিতা করবে।
তিনি আরও জানান, জেলাকে ভিক্ষুক মুক্ত ঘোষণা করতে প্রতিটি উপজেলায়-ই কাজ চলছে। ইতিমধ্যে সদর উপজেলার একাটুনা, আখাইলকুড়া ও আমতৈল ইউনিয়নকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
মোরছালিনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কবে বাড়ি যাবেন, এমন প্রশ্ন করলে উত্তরে বলেন, আর কিছুদিন পরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাব। অনেক দিন হয়েছে মা-বাবারে দেখি নাই।
মোরছালিনের মা-বাবাও হয়তো পথপানে অপেক্ষা করছেন সন্তান কখন আসবে, কখন জড়িয়ে ধরবেন। কারণ মা-বাবার কাছে মোরছালিনরা অসুস্থ নন, সব সময়ই পূর্ণাঙ্গ মানুষ!
এনএ