সহযোগিতায় ঘুরতে পারে আনারুলের জীবন

২৩ বছর আগে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবগঠিত গড়াইটুপি ইউনিয়নের দিনমজুর আরশাদ আলী ও আমেনা বেগমের ঘরে জন্ম নেয় আনারুল ইসলাম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আনারুল সবার ছোট। সবেমাত্র প্রাথমিকের একধাপ পার করেছে। অনেক আশা ছিল লেখাপড়া করে আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনের।
সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজে একটা কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। মাত্র কয়েকদিনের অসুস্থতা তার সেই স্বপ্নকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। একটি ঝড়ে তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। জীবনের সব স্বপ্ন থেকে যায়। তারপরও নিজের লেখাপড়াকে থামিয়ে রাখেনি। অদম্য মনের জোড়ই সে এগিয়ে চলেছিল। এরই মধ্যে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে ৬ষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে আনারুল।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ সময় টাইফয়েড জ্বরে নেমে আসে আনারুলের জীবনে কালো আঁধার। কোনো চিকিৎসা করেও আরোগ্য লাভ হয়নি। প্রতিবন্ধীর অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মায়ের মৃত্যু আর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে তার জীবনে হয়ে ওঠে আরেক অভিশাপ। সেই থেকে পড়ালেখা মুখ থুবড়ে পড়ে।
দ্বিতীয় বিয়ে করার পর জন্মদাতা পিতা তার নেন না খোঁজ, আপন দু’ভাই-বোনই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন। প্রতিবন্ধী হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের কোনো বিত্তবান আজও কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। আজও পায়নি প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সরকারের দেয়া অন্যান্য সুবিধা।
প্রতিবন্ধীর অভিশাপ নিয়ে বাড়িতে বসেই সময় পার করতে হয় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি ইউনিয়নের বাঙ্গালপাড়ার আরশাদ আলীর ছেলে আনারুল ইসলামের। সেই ৮ বছর বয়স থেকে প্রতিবন্ধীর অভিশাপ নিয়ে বেড়ে ওঠা আনারুল আজ ২৩ বছরের যুবক। প্রতিবন্ধীর অভিশাপ নিয়ে দীর্ঘ ১৫টি বছর পার করলেও আজও পাইনি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড।
প্রতিবন্ধীদের জন্য দেওয়া সরকারি সুবিধা পেতে তাকে কি আরেকধাপ প্রতিবন্ধী হতে হবে? আর কতোদিন পরিবারের বোঝা হয়ে থাকবে সে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তার স্বপ্ন নিজে কিছু করার। অদম্য সেই স্বপ্নটাকে বুকে ধারণ করে আজও অপেক্ষার প্রহর গুনছে আনারুল ইসলাম। কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি কি এগিয়ে আসবে আনারুলের সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে?
আনারুলের এই পঙ্গুত্ব যেন সৃষ্টিকর্তারই এক পরীক্ষা। সৃষ্টিকর্তা হয়ত ভালো প্রতিদান দেবে বলেই হুইলচেয়ারে বসে দুর্বিষহ জীবন কাটানো আনারুলকে আজও পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছেন।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করা অবস্থায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে আনারুল ইসলামের নামের পাশে যোগ হয় প্রতিবন্ধী। শারীরিক ক্ষমতা না থাকলেও মনের জোরে লেখাপড়া চালিয়ে যায় সে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা অবস্থায় তার জীবনে নেমে আসে আরেক অভিশাপ।
মা আমেনা বেগমের মৃত্যু আনারুলের জীবনযাত্রা থমকে যায়। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর আনারুলের বাবা আরশাদ আলী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই থেকে আরশাদ আলী তার ছেলেদের আর কোনো খোঁজ রাখেন না। বন্ধ হয়ে যায় তার পড়ালেখা। হয়ে ওঠে পরিবারের বোঝা। বাবা তাকে পর করে দিলেও আপন দু’ভাই-বোন তাকে পর করতে পরেনি। সেই থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী আনারুলকে দেখাশোনা করে চলেছে বড় ভাই জহুরুল ইসলাম ও একমাত্র বোন রুমা খাতুন।
চলাফেরা করতে না পারা আনারুল ইসলামের জন্য একটি হুইলচেয়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া ছবিটি ভাইরাল হয়। ছবি দেখে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামের কোমল হৃদয়ে নাড়া দেয়। পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম তার নিজ অর্থায়নে আনারুলকে একটি হুইলচেয়ার কিনে দেন এবং চিকিৎসার জন্য দেয় ২ হাজার ৬০০ টাকা।
আনারুল ইসলাম বলেন, আর কারও অনুগ্রহের পাত্র হয়ে থাকতে চাই না। নিজে কিছু করতে চাই। এর জন্য প্রয়োজন টাকা। টাকা পেলে সে নিজে কিছু করার পরিকল্পনা নিতে পারত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দিলেও সরকারিভাবে কোনো কিছু সহযোগিতা পাইনি। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকসহ সমাজের বৃত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
আনারুলের বড় ভাই জহিরুল বলেন, বছরচারেক আগে মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর পর বাবা বিবাহ করে অন্যত্র সংসার করছেন। এতে ছোট ভাই আনারুল একা হয়ে যায়। আমি ও আমার স্ত্রী তাকে দেখাশোনা করি। আনারুলের মেধাশক্তি খুবই ভালো। যে একটি দোকান দিতে চাচ্ছে। তার কাছে কোনো পুঁজি নাই।এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো সাহায্য পায়নি।
প্রতিবেশীরা বলেন, আনারুল কোনো কাজই করতে পারে না। ওর মায়ের মৃত্যুর পর বাবা বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছে। ওর বড় ভাই ও ভাবি দেখা শোনা করছেন। আমাদের সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি।
গড়াইটুপি ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান রাজু বলেন, আমি লোক মারফতে শুনে খোঁজখবর নিয়েছি। খুব দ্রুত মাসিক কিছু টাকাসহ সরকারিভাবে ভাতার ব্যবস্থা করে দেব।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মৌমিতা পারভীনের বলেন, আনারুল ইসলামের প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়াও সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
এমএসআর