কীটনাশক প্রয়োগের পর নিস্তেজ হয়ে পড়ে সবজি চারা

ভোলায় ফসলি জমিতে শিকড় পচা রোগ প্রতিরোধে ছত্রাকনাশক অ্যাথারটন ইমব্রুস কোম্পানি লিমিটেডের ‘ভালকান’ নামক কীটনাশক প্রয়োগের এক দিনের মাথায় জমিতে থাকা সবজি চারাগুলো পুড়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। এতে প্রায় সাত লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েন প্রান্তিক কৃষকরা।
ঘটনাটি ঘটে ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে। এই গ্রামের কৃষক মো. জাকির হোসেন, লোকমান মাতব্বর ও জাহাঙ্গীর সর্দার তিন একর ফসলি জমি লগ্নি নিয়ে শীতকালীন সবজি চাষাবাদ করেন। তারা সবজিখেতে শিকড় পচা রোগ প্রতিরোধে রাজাপুর ইউনিয়নের মিজি বাজারের মেসার্স সাব্বির ট্রেডাস থেকে ছত্রাকনাশক ভালকান কীটনাশক কেনেন।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জাকির হোসেন বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে জমি লগ্নি নিয়ে প্রতিবছর আগাম সবজি আবাদ করেন। চলতি বছর ১৬০ শতাংশ জমি লগ্নি নিয়ে সবজি চাষ করেছেন। সার প্রয়োগ, বীজ বপন, চারা উত্তোলন ও লাগানোসহ জমিতে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার। গাছের চারা সবুজ ও ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা হলে বিগত সময়ের মতো শিকড় পচা রোগ প্রতিরোধে ভালকান কীটনাশক ব্যবহার করেছেন।

তিনি জানান, নিয়ম মাপিক ৫০ গ্রাম ভালকান পাউডার ২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিটাতে হয় ফসলে। কিন্তু প্রতিবছরের তুলনায় এ বছরের চিত্র ভিন্ন। কীটনাশক ছিটানোর এক দিনের মধ্যেই চারাগুলো মারা যায়। বড় বড় লাউগাছের লতা এখন পুড়ে যাচ্ছে। তবে আগে ভালকান কীটনাশক ব্যবহার করলেও এবারের মতো ক্ষতি হয়নি কখনো বলে জানান তিনি।
একই রকম ক্ষতির শিকার কৃষক মো. লোকমান মাতব্বর ৮ শতাংশ জমিতে সবজি চাষাবাদ করেছেন এবং জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার ১২০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেছেন। তারাও ভালকান কীটনাশক ব্যবহার করেন।
তারা বলেন, আমাদের ১৬০ শতাংশ জমির বার্ষিক লগ্নিমূল্য ৮০-৯০ হাজার টাকা। আগাম মৌসুমে চিচিঙ্গা, শসা, করোলা, ক্যাপসিকাম আবাদ করি কারণ এ সবজি ঢাকায় নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করবেন ব্যবসায়ীরা। তাই শীত আসার আগেই বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদন করতে হয়। কারণ শীতে বীজ গজাতে সমস্যা হয়। এখন আমাদের শসাগাছে ফুল এসেছে। কিন্তু কীটনাশক দেওয়ায় সবজির চারা মারা গেছে। এতে প্রায় ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমাদের।
এমন খবর শুনে সরেজমিনে যান সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি জানান, রাজাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের তিনজন কৃষক ৯ দিন আগে (১৪ নভেম্বর) তাদের খেতের চিচিঙ্গা, লাউ, করোলা ও শসার চারাগাছে 'ভালকান' কীটনাশক প্রয়োগ করেন। কৃষকের ভাষ্যমতে, ছিটানোর প্রায় এক দিনের মধ্যেই সবজি চারাগুলো মারা যায়। তিনি শুক্রবার রাতে খবর পেয়ে শনিবার সকালে ঘটনাস্থল দেখতে যান।

কী কারণে চারা মারা গেছে, তা এখনো প্রমাণ হয়নি। যদি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ছত্রাকনাশক ছিটানো হয়, তবে গাছ মরবে না। গাছ স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে, গাছ বড় হবে না। আবার যদি আগাছানাশক, কীটনাশক বা বালাইনাশকের সঙ্গে মিশিয়ে ছিটানো হয়, তাহলে বিক্রিয়ায় এ রকম হতে পারে। কিন্তু কৃষকদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এগুলো তারা কিছুই করেনি। তাই অন্য একটি খেতের সবজি গাছে পরীক্ষামূলক ছিটানো হয়েছে।
এদিকে ভালকান কীটনাশকের ডিলার জসিম উদ্দিন এবং সাব-ডিলার মো. ইউনুস সরদার বলছেন, ছত্রাকনাশকের লিকুইডের সঙ্গে অন্য কোনো বালাইনাশক বা কীটনাশক মিশিয়েছেন কি না তারা, এ কারণে পরীক্ষা করার জন্য দুজন কৃষকের নতুন সবজিখেতের চারায় ভালকান প্রয়োগ করা হয়। পরে তাদের খেতের চারাও মারা যায়।
ভোলা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রিয়াজউদ্দিন বলেন, তারা ভালকানের নমুনা ল্যাবে পাঠিয়েছেন। যদি চারা মারা যাওয়ার কোনো কারণ পাওয়া যায়, তবে লাইসেন্স বাতিলের জন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তোপের মুখে ছত্রাকনাশক 'ভালকানে'র বাজারজাত কোম্পানি অ্যাথারটন ইমব্রুস লিমিটেড ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। ছত্রাকনাশক ভালকানের উৎপাদন কোম্পানীর বরিশাল বিভাগীয় বিক্রয় ব্যবস্থাপক মো. সোলাইমান হাওলাদার ভোলার কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত তিন কৃষককে বীজ ও সার কেনার জন্য নগদ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও প্রয়োজনমতো ছত্রাকনাশক প্রদানের সিদ্ধান্ত জানান।
তিনি বলেন, ভালকান কীটনাশক মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এমনটা হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই কীটনাশকটি কৃষি বিভাগের মাধ্যমে টেস্টে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ভালকান কীটনাশকের প্যাকেটের গায়ে লেখা ভলকান একটি অর্গানো কার্বোনেট জাতীয় ছত্রাকনাশক। শিকড় পচা রোগে সবজি ছাড়া আম ও কলাগাছেও ছিটানো যায়। এই ছত্রাকনাশকের প্রস্তুতকারক চিনের কুইনদাও হোয়াচেন কেমিক্যাল করপোরেশন। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের অ্যাথারটন ইমব্রুস কোং লিমিটেডের বিক্রেতা। খুচরা বিক্রয় মূল্য ৭১০ টাকা। ২০২৩ সালে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মেয়াদ আছে।
এনএ