ফেলনা জুতায় চলছে সংসার

প্রায় ৪০ বছর আগে বন্ধুদের সঙ্গে রাজশাহী শহরে ঘুরতে এসেছিলেন বিরেন দাস। হাতে ছিল না টাকা-পয়সা। তবে জানতেন জুতা সেলাইয়ের কাজ। নগরীর রেলওয়ে স্টেশনের সামনের ফুটপাতে একদিন বসে পড়েন জুতা সেলাইয়ে। সেই থেকেই জুতা সেলাইয়ের কাজ করছেন। কিন্তু মহামারি করোনা সত্তরোর্ধ্ব বিরেন দাসের মাথার ছাদ কেড়ে নিয়েছে। এখন সড়কের পাশের অস্থায়ী আমের আড়তে রাত কাটে তার।
বিরেন দাস বলেন, একটা সময় ছিল জুতা সেলাই করে ভালোভাবেই সংসার চলেছে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলেকে বড় করেছি এই আয় থেকেই।
বড় ছেলেও বাবার পেশায়। কিন্তু বিয়ে করে এখন তার আলাদা সংসার। ছোট ছেলের এই পেশায় আপত্তি। তিনি নরসুন্দর। তবুও বাবার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছেন ছোট ছেলে।
বিরেন দাস জানান, পরিবার নিয়ে রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন শিরোইল এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন তিনি। বাসাভাড়া ছিল চার হাজার টাকা আর গ্যাস-বিদ্যুতের বিল আরও দেড় হাজার টাকা। করোনায় টান পড়ে আয়ে। ফলে বাধ্য হয়ে তিন মাস আগে বাসা ছেড়ে দেন। পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দেন গ্রামের বাড়ি জেলার পুঠিয়া উপজেলার আড়ানীতে। স্থানীয় একটি আমের আড়তের অস্থায়ী মাচানে এখন রাত কাটে জীবনযুদ্ধে হার না মানা এই বৃদ্ধের।
তিনি জানান, সংসার চালাতে এক সময় এনজিও থেকে চড়া সুদে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তিনি দৈনিক আয় করেন দেড়শ থেকে ২০০ টাকা। এই টাকা চলে যায় কিস্তি দিতেই। ছেলের আয়ে কোনো করমে সংসার চলছে।
বিরেন দাস জানান, এখানে বসতে কেউ বাধা দেয় না। মাঝে মধ্যে সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে তুলে দেয়। তখন তাদের পথে বসতে হয়। পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়।
রেলস্টেশন সংলগ্ন ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকার ফুটপাতে এখন তার অস্থায়ী দোকান। সেখানে সবমিলিয়ে ১০ জন বসেন। প্রত্যেকের জীবনের গল্প প্রায় একই। তবে এখনও চোখজুড়ে স্বপ্ন দেখেন ৩৪ বছর বয়সী প্রশান্ত দাস (৩৪)। বাবা প্রভাস দাসের সঙ্গে তিনি কাজ করছেন এখানে। তারা মূলত ফেলনা জুতা কেনাবেচা করেন। মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা আয় করেন বাবা-ছেলে মিলে। দুই মেয়ের পড়াশোনা এবং পরিবারের খরচা মিটে যায় এই আয় থেকেই।
প্রশান্ত দাস জানান, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভাঙাড়ির সঙ্গে ফেরিওয়ালারা নষ্ট জুতা সংগ্রহ করেন। তারাই তাদের কাছে এসব জুতা পৌঁছে দেন। যখন রাজশাহীতে ফেলনা জুতা পাওয়া যায় না, তখন তারা ঢাকায় গিয়ে বেছে বেছে এসব জুতা কিনে আনেন। প্রতি হাজার ফেলনা জুতা কেনেন অন্তত ৭০ হাজার টাকায়।
রাজশাহীতে নেয়ার পর সেই জুতা ধুয়ে রঙ করেন। যেসব জুতার সোল থাকে না তাতে সোল লাগান। টুকটাক মেরামত করে প্রতিজোড়া জুতা ২শ টাকা থেকে সাড়ে ৩শ টাকায় বিক্রি করেন। সস্তায় পাওয়া এই জুতার ক্রেতা প্রধানত নিম্ন আয়ের লোকজন। বিশেষ করে কম বেতনের মাঠকর্মী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী, পরিবহন সুপারভাইজার এমনকি অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরাও এই জুতা কেনেন।
তিনি আরও জানান, এক সময় তার বাবা-দাদারা বাঁশ-বেতের কাজ করতেন। কিন্তু বাঁশ-বেতের যোগান কমে যাওয়ায় পর তার বাবা জুতা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। বাবার দেখা দেখি প্রায় ২২ বছর আগে তিনিও এই পেশায় আসেন।
তবে এই ফুটপাতে জীবন কাটিয়ে দিতে নারাজ প্রশান্ত দাস। তিনি বলেন, পুঁজি হলেই তিনি দোকান দিতে চান। আর সহায়তা পেলে দিতে চান জুতার কারখানা। নিজেরসহ অনেকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে চান।
প্রায় ৩০ বছর ধরে ফেরি করে রাজশাহী নগরীতে ফেলনা জিনিষপত্র কেনেন আবদুল জলিল। তিনি দুই জোড়া জুতা হাতে এসেছিলেন বিক্রি করতে। তিনি জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এইভাবে জুতা সংগ্রহ করেন। আগে জুতা ফেলে দিত লোকজন। সেগুলো তিনি কুড়িয়ে আনতেন। এখন লোকজন জুতা বিক্রি করেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিজোড়া জুতা ৫০ থেকে ১০০ টাকায় কেনেন তিনি। ১০-২০ টাকা বেশি পেলে তা বিক্রি করে দেন।
আরএআর