অজানা ঝড়ে কৃষক বাবার স্বপ্ন শেষ, পরীক্ষার ফল এখন শুধুই স্মৃতি

প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। অনেকের মতোই ভালো ফল পেয়েছেন সাব্বির ইসলাম (১৯)। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা স্বনামধন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষক বাবা রফিকুল ইসলাম। তবে তার সেই স্বপ্ন আজ শুধুই স্মৃতি। ছেলে সাব্বির ইসলামের করুণ মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা সাজেদা বেগম। সাব্বির পৃথিবীতে নেই- এটা মানতে নারাজ তার সহপাঠী, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরাও।
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের রাঘবেন্দপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে সাব্বির ইসলাম। সাব্বির গত শনিবার (৩০ জানুয়ারি) প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৭৫ পেয়েছেন। তবে অটোপাস পদ্ধতি চালু না থাকলে সাব্বির জিপিএ-৫ অর্জন করতেন বলে দাবি পরিবারের।
গত ১৪ জানুয়ারি গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার সিএনবি মোড়ে ট্রাকচাপায় নিহত হন সাব্বির। এতে ভেঙে যায় মা-বাবার স্বপ্ন। তবে এ মৃত্যুর জন্য পুলিশকে দায়ী করছেন সাব্বিরের বাবা রফিকুল ইসলাম।
জানা গেছে, কৃষক রফিকুল ইসলামের দুই ছেলে। নিজের অভাব-অনটন ও কষ্ট কখনই ছেলেদের বুঝতে দেননি তিনি। আকাশ ভরা কষ্ট বুকে চেপেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। এজন্য নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেন দুই ছেলের পড়ালেখার পেছনে। এক সময় ছেলেদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে এই নিজ জেলা ছেড়ে ভিন্ন জেলায় গিয়ে দিনমজুরের কাজ করেছেন। এমনকি ঢাকাতেও রিকশা চালিয়েছেন।
বড় ছেলে শাহজালাল হোসেন আকাশ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধীনে নার্সিংয়ে বিএসসি শেষ বর্ষে পড়ালেখা করছেন। ছোট ছেলে সাব্বিরকেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রত্যয় ছিল রফিকুল ইসলামের। ছেলে সাব্বিরের স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে পুলিশের উচ্চ পদে চাকরি নেয়ার। ছেলের সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে একাত্মতা পোষণ করেন বাবাও। তাই তো সব আবাদি জমি বিক্রি করে এখন অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তিনি। পাশাপাশি লাখ টাকা ব্যাংক ঋণের বোঝাও মাথায় রয়েছে রফিকুল ইসলামের।
এদিকে আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা রফিকুল। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীও সাব্বিরকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ। সেই সঙ্গে মা সাজেদা বেগম ছেলেকে হারিয়ে শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কিছু সময় পরপর হাউমাউ করে কেঁদে ছুটে যাচ্ছেন ছেলের কবরের পাশে।
রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৪ জানুয়ারি বাড়ি থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় সাব্বির। পথে পলাশবাড়ির সিএনবি মোড়ে একটি ট্রাককে থামানোর সংকেত দেন দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ। পাশাপাশি বিপরীত দিক যাওয়া সাব্বিরকেও থামতে বলা হয়। এ সময় সংকেত দেয়া ট্রাকটির পেছনে থাকা আরেকটি ট্রাক অভারটেক করে যাওয়ার সময় সাব্বিরকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সাব্বির। সেই সঙ্গে মোটরসাইকেলটিও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ঘটনার পর দুই পথচারী সাব্বিরকে উদ্ধার করে পলাশবাড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর আমি মৃত্যুর সংবাদ পাই। পরে আমি হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সাব্বিরের মরদেহ বাড়িতে পাঠায় পুলিশ।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে লাশ রেখে পুলিশ ঘাতক ট্রাকটি আটক না করে উল্টো আমার ছেলের মোটরসাইকেল থানায় নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত সেই ট্রাকের চালক, হেলপার ও ট্রাকটি শনাক্ত কিংবা আটক করতে পারেনি পুলিশ। আমি এই ঘটনার সঠিক কারণ, তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানাই।
সাব্বিরের মা সাজেদা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ছেলে সাব্বিরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে আজ খানখান হয়ে গেছে। এইচএসসির রেজাল্ট পাওয়ার পর থেকে পরিবারে খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সাব্বির বেঁচে থাকলে আনন্দ উল্লাস করত। বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসত। সবই এখন অধরা স্বপ্ন। ভালো জায়গায় ভর্তির জন্য কষ্ট করে টাকা জোগার করতাম। এতেও অনেক আনন্দ ছিল। এই ত্যাগের মধ্যেও সুখ ছিল। এই সুখ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম।
সাব্বিরের বাবার অভিযোগের বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট আবদুল আজিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। গত ১৪ জানুয়ারি দুপুরের দিকে কোনো ট্রাক কিংবা মোটরসাইকেলকে কোনো সংকেত দেয়া হয়নি। আমি ঘটনার সময় নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম। এ সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে সেখানে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় সাব্বিরকে দেখতে পেয়ে বিষয়টি হাইওয়ে পুলিশ ও পলাশবাড়ি থানাকে অবগত করি। সাব্বিরকে উদ্ধারের সময় হঠাৎ মহাসড়ক ফাঁকা পেয়ে রংপুরের দিকে ট্রাক নিয়ে সটকে পড়ে চালক। এরপর বড়দরগা ও রংপুর হাইওয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েও ঘাতক ট্রাকটি আটক করা সম্ভব হয়নি বলেও জানান তিনি।
আরএআর