‘ভাষা আন্দোলনের পথেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার উন্মেষ’

ভাষা আন্দোলনের পথেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার উন্মেষ ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজশাহীর ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে এই মন্তব্য করেন তিনি।
প্রবীণ এই ভাষাসৈনিক রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা। ১৯৫২ সালে নগরীর লোকনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ছিলেন রাজনীতি সচেতন। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। সেই থেকেই যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। কেবল ভাষা আন্দোলনই নয়, বাঙালির পক্ষের সব আন্দোলন সংগ্রামে সরাসরি অংশ নেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী।
যে তারুণ্যে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, সেই তারুণ্য নিয়ে একরাশ হতাশা এই ভাষা সংগ্রামীর। তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আমরা যে বাঙালি জাতিসত্ত্বার উন্মেষ ঘটিয়েছিলাম, সেটা এখন অনেকটাই নিস্তব্ধ, নিথর। তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে, নেশাগ্রস্ত হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতির লালন হচ্ছে না। ইংরেজির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ধর্মীয় নানা অপপ্রচারের মধ্যদিয়ে এরা ধর্মান্ধ হচ্ছে। নানানমুখী সাম্প্রদায়িক চেনতায় তারা লালিত হচ্ছে।
তরুণদের পথে আনতে বাঙালি সংস্কৃতির লালন ও পালন করা জরুরি উল্লেখ করে এই ভাষাসৈনিক বলেন, এখনকার তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডুবে থাকছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয়ে পড়েছে রেডিও-টেলিভিশমুখী। এই চর্চা বন্ধ করে সামাজিকভাবে পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা দরকার।
তরুণদের বিপথগামী হওয়ার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক চর্চার অভাবকেও দায়ী করেছেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। তিনি বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র অনেকটাই স্তমিত হয়ে পড়েছে। এখানে সঠিক রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে রাজনীতি বন্ধ্যা হয়ে আছে।
৫২’র উত্তাল দিনগুলোতেও ফিরে যান এই অশীতিপর। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনে ঢাকার পরই অবস্থান ছিল রাজশাহীর। সব আন্দোলনই এখানে জোরদার ছিল। এর পেছনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের অবদানও ছিল।
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে ভর্তি হতেন। রাজশাহী কলেজই ছিল দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি। এখান থেকেই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব বেরিয়ে এসেছে। সমস্ত আন্দোলন ছিল রাজশাহী কলেজকেন্দ্রিক।
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত সহজ ছিল না। মোবাইলও ছিল না। সেই সময় ঢাকা থেকে রাজশাহীতে একটা ট্রেন আসত সন্ধ্যার আগে আগেই। ঢাকায় কি হচ্ছে তা জানার জন্য আমরা স্টেশনে উন্মুখ হয়ে বসেছিলাম। ট্রেনে আমাদের একজন কর্মী এসে জানালেন, ভাষা আন্দোলনের মিছিলের ওপর গুলি হয়েছে। তাতে বহু ছাত্র ও সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে।
এই খবর পেয়ে আমরা রাজশাহী কলেজের তৎকালীন নিউ হোস্টেল (মুসলিম ছাত্রাবাস) চত্বরে সমাবেত হলাম। ডা.এসএম গাফ্ফারের সভাপতিত্বে ওই জমায়েত থেকে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সেখানে ভাষা শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, ওই দিন রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করে কাদার গাঁথনিতে ইটপাটকেল দিয়ে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বানায় আমরা। তার মধ্যে লিখে দেওয়া হয়, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
আমরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে বাড়ি ফিরে যাই। বাড়ি থেকেই খবর পাই তৎকালীন মুসলিম লীগের গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশ মিলে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি গুড়িয়ে দেয়। তাদের পাষবিক কর্মকাণ্ড আমরা কেবল নিরবে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। তবুও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এই আন্দোলন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আমরা জয়ী হই। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার রূপ দান করতে সক্ষম হই।
রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে প্রবেশের প্রধান ফটকের ডান দিকে নির্মিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এটিই দেশের প্রথম শহীদ মিনার দাবি করেন ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। তিনি বলেন, রাজশাহীর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটিই দেশের প্রথম শহীদ মিনার। আমরা বরবরই বলে আসছি, আমাদের এই শহীদ মিনারকে প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। কিন্তু আজও এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তার মধ্যে একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল। ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছিল একটি আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত থাকবে না। সে নাগরিক হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তার পরিচয় হবে বাঙালি।
বাংলা ভাষার আন্দোলন করতে গিয়ে বাঙালিরা জাতীয় সম্ভ্রম বোধ ফিরে পায়। বাঙালি জাতীয় সত্ত্বার জাগরণ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা গড়ে ওঠে। অথচ আমরা এখনও সম্পূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক হতে পারিনি।
ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান এই ভাষাসৈনিক। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়ছে, তারা অবশ্যই ইংরেজি ভালো শিখবে। তার সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলাও শিখতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই ভাষাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না।
অফিস-আদালতে বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে এই ভাষাসৈনিক বলেন, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। যে রায়গুলো হচ্ছে সেগুলোও ইংরেজিতেই হচ্ছে। তিনি বাংলায় রায় দেওয়ার কথা বলেন। তবে কোনো মোকদ্দমা বিদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে ইংরেজিতেও রায় হতে পারে। তাতে আমার কোনো সংকীর্ণতা নেই। সাইনবোর্ড ইংরেজিতে নয়, অবশ্যই বাংলায় রাখতে হবে। কেউ মনে করলে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিও রাখতে পারেন। এটি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বাংলাকে প্রমিত ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গবেষণা কমিটি হওয়া উচিত বলেও মনে করেন ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। তিনি বলেন, বিজ্ঞানের পরিভাষা এখনো সম্পূর্ণ বাংলা হয়নি। অথচ আমাদের কাছাকাছি দেশ চীন, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়ায় নিজ নিজ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছে। উচ্চ জ্ঞান-বিজ্ঞানেও মাতৃভাষা চর্চা করে। কিন্তু আমরা এখনো মান্ধাতার যুগে পড়ে আছি।
শুধু আমরা সাহিত্য ও কবিতা পড়ি; কিন্তু বাংলাকে আমাদের জীবনমুখী করে গড়ে তোলার জন্য সেই চেষ্টাটুকুও করি না। তাই স্বাধীনতার পক্ষের সরকারের কাছে দাবি থাকবে, বাংলার প্রতি হেলাফেলা না করে গুরুত্ব দেওয়া হোক। আমাদের বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি সেই হিসবেই পরিচয় হোক।
ভাষা আন্দোলনের ৭০ এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নেই। ভাষাসৈনিক হিসেবে এ নিয়ে আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী বলেন, এই দাবি আমাদের অনেক পুরোনো। এই দবি বাস্তবায়নের পথে।
রাজশাহীর বর্তমান মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহীর সমস্ত নেতাদের নিয়ে পুরাতন সার্ভে ইনস্টিটিউটে বৈঠক করেন। সেখানেই ওই জায়গায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে তিনিসহ ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুও উপস্থিত ছিলেন। তারাও সেই মঞ্চে বক্তব্য দেন। এজন্য মেয়রকে তারা ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বাস্তব রূপ পায়নি। দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হবে-এমন আশাবাদ এই ভাষাসৈনিকের।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এসপি