পরিবার নিয়ে গোয়াল ঘরে বাস করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফরিদ

ঘরে একটি মাত্র চৌকি। চৌকির এক কোণে বসে আছেন ফরিদ হোসেন। পাশে শুয়ে আছেন স্ত্রী-সন্তানরা। ঘরে তিনটি ছাগল ও একটি গরুও দেখা গেল। নেই কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ। গরু-ছাগলের সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এভাবেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফরিদ হোসেন।
ফরিদ হোসেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মুন্সিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। মাত্র দুই বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চোখের দৃষ্টি হারান। ছোটবেলায় অন্যের সহযোগিতা নিয়ে পথ চলতেন। ধীরে ধীরে আন্দাজ করে চলাফেরা শুরু করেন। এখন শাক বিক্রি করেন জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রী নাজমা বেগম কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। তাদের ঘরে দুই ছেলে ও দুটি মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ের বয়স ১১ বছর। পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে।
প্রতিবেশী সেলিনা বেগম বলেন, ফরিদের ঘরে দুটি হাড়ি, দুটি গ্লাস আর তিনটি প্লেট রয়েছে। খুব কষ্ট করে ওরা দিন রাত পার করে। সব সময় হাসিখুশি থাকলেও রাতে ফরিদ ঘুমায় না। একা একা রাস্তায় পায়চারী করে। ফরিদের জন্য খুব কষ্ট হয়।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, ফরিদ ধামির্ক ছেলে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। অন্ধ হয়েও সে ভিক্ষা করে না। সম্মান নিয়ে সে চলতে চায়। সরকার তাকে সামান্য সহযোগিতা করলেও সে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে। তাকে সরকার থেকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে সে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারবে।
ফরিদের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, অন্ধ স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে অনেক কষ্ট করে জীবন চালাতে হয়। একটা ঘরেই গরু-ছাগলসহ দিন কাটে আমাদের। আমার সন্তানদের পড়াশোনার জন্য সবার সহযোগিতা চাই।
ফরিদ হোসেন বলেন, ছোটবেলায় আমি দৃষ্টি হারায়। তারপর থেকেই আবছা আর অনুমান করে জীবন চলছে। আমার চার সন্তান আছে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর তিন সন্তান ছোট। শাক বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চলে। আমি কিভাবে আমার সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করব এটা নিয়েই চিন্তা করি।

তিনি আরও বলেন,আমি একজন অন্ধ মানুষ। অন্ধ হলেও আমার ঘরে স্ত্রী-সন্তানরা কতটা কষ্টে থাকে তা উপলব্ধি করতে পারি। আমার ঘরে মাত্র একটি চৌকি। শীত নিবারণের জন্য নেই তেমন বস্ত্র। একটু বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি জমে। মাটির ঘরটিও অনেক পুরোনো। ঘর ভেঙে পড়তে পারে যখন-তখন। রাতে ঘুমাতে পারি না। সারা রাত রাস্তায় হাঁটাহাটি করি। ঘরের মেঝেতে ঘুমাতে পারি না। মেঝেতে গরু-ছাগলের মলমূত্রের দুর্গন্ধে টিকতে পারি না। বিশ্বাস না হলে আমার ঘরটা দেখে যান। চোখে দেখতে পারলে জঙ্গলে হলেও একটা ঘর পেলে আমি পরিবার নিয়ে থাকতে পারতাম।
সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হেল্প ঠাকুরগাঁওয়ের সভাপতি লাভলী আক্তার বলেন, ফরিদ হোসেনের বিষয়টি অনেক কষ্টের। এক ঘরে গরু-ছাগলের সঙ্গে বসবাস করেন। তাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। আমরা হেল্প সোসাইটির পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করব। তার সন্তানরা যেন পড়াশোনা করতে পারে সেজন্য সহযোগিতা করা হবে। সেইসঙ্গে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান করছি।
ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কুলুরাম রায় বলেন, ফরিদকে গুচ্ছগ্রামে একটি ঘর দিতে চেয়েছিলাম। ফরিদ বলেছিল ওখানে সে চলাফেরা করতে পারবে না। পরে ভেবে দেখলাম অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না। তবে ফরিদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা জরুরি।
আকচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মণ বলেন, ফরিদ হোসেন একজন অন্ধ মানুষ। আমরা তাকে প্রতিবন্ধী কার্ডসহ স্থানীয় যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে তা দেওয়ার চেষ্টা করি। আর ঘরের জন্য হলে তাকে ইউএনও অফিস বা ডিসি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফরিদের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তাকে সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।
এমএ সামাদ/এসপি