ইউপি সদস্যকে টাকা দিয়েও মেলেনি ঘর

কিছু মানুষের জন্ম যেন কষ্ট ও অভাবের বিরুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবেই। জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত এসব মানুষ বেঁচে থাকেন অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেই। সারা দিনের জীবনযুদ্ধ শেষে নিজের ঘরে শান্তির নিদ্রার সৌভাগ্যও যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবু হাল ছেড়ে দেন না তারা। একটি ঘরের আশায় সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ অন্যকে বিশ্বস্ত ভেবে হাতে তুলে দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন তারা।
অভিযোগ আছে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য হাতিয়ে নিয়েছেন গরিবের লাখ লাখ টাকা।
সম্প্রতি সরকার ‘জমি আছে ঘর নাই’ ও ‘জমি-ঘর কিছুই নাই’, এমন জনগণের তালিকা তৈরি করে বিনা মূল্যে ঘর ও জমি বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। আর এই সুযোগে সাভারের বিরুলিয়া ও আশুলিয়া ইউপির মহিলা ওয়ার্ড সদস্য ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসহায় দরিদ্রদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সারুলিয়া এলাকার ইউপি মহিলা সদস্য সেলিনা বেগম ও আশুলিয়ার দোসাইদ এলাকার মহিলা সদস্য সালমা বেগম প্রায় ৪০টি পরিবারের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন।
কথা ছিল, যাদের জমি আছে ঘর নেই ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের নির্মাণ করে দেওয়া হবে ঘর। কাউকে বলা হয়েছে এনজিও থেকে কাউকে বলা হয়েছে সরকারি বরাদ্দ থেকে দেওয়া হবে এসব ঘর। টাকা দিলেই তারা পাবেন ৫ লাখ টাকা মূল্যের ঘর। একটি ঘরের আশায় এসব পরিবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আস্থা রেখে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন সারা জীবনের কষ্টার্জিত শেষ সম্বলটুকু। বিনিময়ে পেয়েছেন আশ্বাস ও লাঞ্ছনা। অনেকরই সান্ত্বনামূলক শুরু করা হয়েছিল ঘর নির্মাণের কাজ। তবে মাসের পর মাস গেলেও তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি।
বিরুলিয়া ইউপির সারুলিয়া এলাকার মহিলা সদস্য সেলিনা বেগমের প্রতি আস্থা রেখে প্রতারণা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন একই এলাকার আশি-ঊর্ধ্ব বাসিন্দা আব্দুল মালেক।
ঢাকা পোস্টকে মালেক বলেন, আমি ছোট্ট একটি ঘরে আমার জায়গাতেই ছিলাম। মহিলা মেম্বর সেলিনা ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি দিচ্ছে শুনে আমিও দুইটা বাড়ির জন্য ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা সেলিনাকে দিই। পরের দিন সেলিনা আসেনি। তার লোকজন এসে বলে, ঘর দ্রুত ভাঙতে হবে। ঘর নির্মাণ শুরু করা হবে। পরে ঘর দ্রুত ভাঙা হয়। শুরু হয় ঘর নির্মাণের কাজ। তবে শুরু হতেই শেষ হয়েছে ঘর নির্মাণের কাজ। প্রায় ছয় মাস ধরে সেলিনার দেখা নেই। এখন টাকা চাইলে সেলিনা খারাপ ব্যবহার করেন, লাঞ্ছিত করেন।
অপর ভুক্তভোগী হাফিজ বলেন, আমি সেলিনাকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা লোন তুলে দিই। কথা ছিল দুটি শয়নকক্ষ, ১টি রান্নাঘর, একটি গেস্টরুম ও একটি শৌচাগার নির্মাণ করে দেওয়ার। কিন্তু সেলিনা শুধু ৩ গাড়ি ইট আর ১ গাড়ি খোয়া দেন। পরে আমি নিজে আরও ইট আর বালু দিই। এভাবে দেয়াল নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন করে নিয়েছি। এখন বাকি কাজ আর সেলিনা করেও দিচ্ছেন না, টাকাও দিচ্ছেন না। আমি অন্যের ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।
এই ইউপি সদস্য ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুধু টাকাই হাতিয়ে নেননি, বিনা মূল্যের সরকারি ঘর দিয়ে বিনিময়ে নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। আর টাকা প্রদানের বিষয়টি কাউকে জানানো যাবে না বলে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথের জন্যও চাপ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে বিরুলিয়া ইউনিয়নের বাগ্নিবাড়ি গ্রামের ভুক্তভোগী সলমা খাতুন বলেন, আমি মেম্বার সেলিনার কাছে ঘর চাইতে গেছিলাম। দুই রুমের ঘর দিতে চেয়ে ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। পরে এক রুমের ঘর দিয়েছেন। আমাকে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে বলেছিলেন, আমি যেন টাকার বিষয়টি কাউকে না বলি। আমি কষ্ট করে টাকা ইনকাম করেছি, কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করব কেন। আমি শপথ করিনি।
অভিযোগের বিষয়ে ইউপি সদস্য সেলিনা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। সেলিনা বেগম ভিডিও বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও টাকা গ্রহণের বিনিময়ে ঘর প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার পাশের ইউনিয়ন আশুলিয়ার (ইউপি) মহিলা সদস্য সালমা কয়েকজনকে ঘর দিয়েছে। এটা আমি জানতে পারি। সামনে নির্বাচনকে ঘিরে আমিও গরিব-দুঃখীদের ঘর দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি সালমার সাথে যোগাযোগ করি।
সলমা বলেন, ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিদেশি সংস্থা ঘর দিচ্ছে। আমি তাকে বলি আমার নির্বাচনী এলাকায় আমিও ঘর দিতে চাই। পরে ৪ জনের নিকট থেকে টাকা নিয়ে তাদের ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করি।
সেলিনা বলেন, এ সময় আরও প্রায় ১৬ জন এসে ঘর নেওয়ার কথা বলেন। আমি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সালমাকে দেই। এখন সালমা আর কাজও করছেন না, টাকাও দিচ্ছেন না। সেলিনা ১৫ দিনের মধ্যে বিষয়টি সমাধান করে দেবেন। গরিবের টাকা ফিরিয়ে দেবেন কিংবা ঘর নির্মাণ করে দেবেন। ১৫ দিনের আগে সংবাদ প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে অনৈতিক প্রস্তাব দেন।
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য সলমা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি আমার নির্বাচনী এলাকার চারজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা নিয়ে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছি। পরে তার ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়। সেলিনা তাকে ঘর নির্মাণের জন্য টাকা প্রদান করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব টাকা সেলিনাই নিয়েছেন। তিনি আমাকে কোন টাকা দেননি।
সাভার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ ব্যাপারে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
তবে সাভার ইউএনও শামীম আরা নিপার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মাহিদুল মাহিদ/এনএ