পরিবারের দেওয়া আত্মবিশ্বাসই বড় পুঁজি

মুবিনা আসাফ। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশের লিগ্যাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান, কাজের পরিবেশ, প্রতিবন্ধকতা, সম্ভাবনাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্ট-এর সঙ্গে। আলোচনায় উঠে এসেছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং শীর্ষপদে নারীদের কম দেখা যাওয়ার কারণসহ নানা বিষয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্ট-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত।
ঢাকা পোস্ট : বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে নারীদের যাওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে?
মুবিনা আসাফ : নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবার বড় ভূমিকা রাখে। পরিবারই প্রথম রোলটা প্লে করতে পারে। নারীদের সব কিছুতে সংযুক্ত করা, সুযোগ করে দেওয়া এমন একটা মাইন্ড সেট যদি আমরা ছোটবেলা থেকে পরিবারের মাধ্যমে পাই তাহলে এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়। সব ক্ষেত্রে বিচরণের জায়গাটা তৈরি হয়।
নারীর ক্ষমতায়নের জায়গাটা শুরু হয় পরিবার থেকে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা যখন কাজ করতে আসি, তখন আমাদের মধ্যে অনেক সময় ডাউট (দ্বিধাদ্বন্দ্ব) কাজ করে। এটাও নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমরা যদি সেলফ বিলিভে টার্ন (আত্মবিশ্বাসে মোড়) নিতে পারি, তাহলে কিন্তু কনফিডেন্স লেভেল বেড়ে যাবে।
একটা মিটিংয়ে যদি টেবিলে বসার জায়গা না থাকে একজন মেয়ে হিসেবে আমরা অনেক সময় সেখানে না বসে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের চেয়ার টেনে নিয়ে সে মিটিংয়ে বসতে হবে। যদি আমার জায়গা না থাকে, তাহলে যেন আমি আমার জায়গাটা তৈরি করে নিতে পারি। তবে আমরা আস্তে আস্তে দেখছি পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এটাকে সুন্দরভাবে গ্রহণ করেছে। নারী-পুরুষরা সমান তালে কাজ করছে। সবাই মিলেই আমাদের কাজের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : শীর্ষ পদে নারীদের কম দেখা যাওয়ার কারণ কী?
মুবিনা আসাফ : আমরা যদি এক দশকের চিত্র দেখি, তাহলে আমরা দেখতে পাব, নারীরা বেশ ভালো করছে এবং এগিয়ে এসেছে। বিএটি বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে আমি নিজেই টপ টিমে গত আট বছর ধরে কাজ করছি। আমার আগে ছিলেন রুমানা রহমান, তিনি হেড অব এইচআর (মানবসম্পদ) হিসেবে ছিলেন। এখন তিনি রিজিওনাল এইচআর হিসেবে বেশকিছু মার্কেটের এইচআরের দায়িত্বে আছেন। শুধু মাল্টিন্যাশনাল না, আমরা যদি লোকাল কোম্পানির (স্থানীয় প্রতিষ্ঠান) দিকেও তাকাই, তাহলে দেখতে পাব বেশকিছু সংখ্যক নারীরা উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছেন এবং বোর্ডেও আছেন। আমাদের দেশের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, অপোজিশন লিডারও (বিরোধী দলীয় নেতা) নারী।
এক্ষেত্রে আমরা অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি। তবে এটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পরবর্তী এক দশকে যেন আমরা নারীদের আরও অনেক উঁচু পর্যায়ে দেখি। এছাড়া আমি খুব আশাবাদী, আগামীতে আমরা আরও সহজভাবে সামনের দিকে পৌঁছাতে পারব।
ঢাকা পোস্ট : মাতৃত্বকালীন ছুটির কারণে অনেক নারী পিছিয়ে পড়েন। বিষয়টি এখনও অনেক প্রতিষ্ঠান সহজভাবে নেয় না। এর জন্য করণীয় কী?
মুবিনা আসাফ : ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির সঙ্গে আরও তিন মাস নারীদেরকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে বিএটি। ওনারা যখন ফেরত আসবেন, তখন এই ট্রানজিশন পিরিয়ড সহজ করতে বাড়িতে বসে কাজ করার সুবিধাও দেওয়া হয়। অর্থাৎ তারা যেন মাতৃত্ব এবং অফিসের দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে পারেন। আমাদের পলিসিগুলোও সেভাবেই করা। আমরা আশা করি, অন্যান্য কোম্পানিরও এমনভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। এছাড়া একজন মাকে মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে সঠিকভাবে কাজে ফিরে আসার মাইন্ড সেট থাকতে হবে। আমি যেন পিছিয়ে না যাই, সেটা সব নারীকেই খেয়াল রাখতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাই...
মুবিনা আসাফ : নারীবান্ধব পরিবেশ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানটি পরপর দুইবার নারীবান্ধব অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। এর পেছনে যে জিনিসগুলো কাজ করেছে সেগুলো মধ্যে অন্যতম, নারীবান্ধব পলিসি, পরিবেশ এবং দৃষ্টিভঙ্গি। আগে যেসব জায়গায় বা পজিশনে নারীরা অতটা আসত না। এখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানে আসছে। যেমন টেরিটোরি অফিসারের রোল, মেশিন অপারেটর রোলেও কিন্তু এখন আমরা নারীদের দেখতে পাচ্ছি। এমনকি তারা নাইট শিফটেও (রাতের বেলা) কাজ করছেন। আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি, কৃষকদের সঙ্গে নারীরাও কিন্তু এগিয়ে আসছেন। এই জায়গায় বেশ কিছু বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি, নারীরা তাদের কর্মস্থলে খুবই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরি করাটা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জরুরি। নারীরা এগিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু মাঠপর্যায়ে অনেকে সময় অসুবিধা ফেস (সম্মুখীন) করে। এ জায়গাতে কাজ করার আরও অনেক সুযোগ আছে, আমাদের সবাইকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : দেশের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
মুবিনা আসাফ : আমাদের দেশে অনেক কোম্পানি নারীদের এমন এমন রোলে (দায়িত্ব) কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, সেসব রোলে আগে কখনও নারীদের দেখা যেত না। এসব পদে নারীরা কিন্তু এখন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছেন এবং ভালো করছেন। আমরা সবাই মিলে যদি কাজের পরিবেশের আদর্শের জায়গাটা ফলো করি, তাহলে কিন্তু নারীবান্ধব পরিবেশ সব জায়গাতেই সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশের ভেতরের অনেক কোম্পানিতেই এমন অনেক উদাহরণ আছে। এসব আমাদের ফলো করা উচিত।
তবে অনেক অফিসে কিন্তু নারীদের আলাদা টয়লেট নেই, এছাড়া আউট স্টেশনে গেলে নারীর যে থাকার জায়গার ব্যবস্থা সেটা মিনিমাম সিকিউরড (ন্যূনতম নিরাপদ) হতে হবে। এমন সব পরিবেশ তৈরি করা গেলে কিন্তু নারীদের জন্য বাইরে কাজ করা কোনো ব্যাপারই না। এই জায়গাটাতে আমরা আশা করছি, আরও অনেক ডেভেলপমেন্ট (উন্নয়ন) দেখতে পাব।
ঢাকা পোস্ট : আপনার এই পথচলার বিষয়ে জানতে চাই...
মুবিনা আসাফ : এটি সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল। যেহেতু আমি আইনজীবী ছিলাম, তাই আমার একটা ল চেম্বার ছিল। একজন নারীর পক্ষে এই পেশা চ্যালেঞ্জের। এরপর আমার একটা সুযোগ এলো করপোরেট জবের, তখন চ্যালেঞ্জটা নিলাম। প্রাইভেট সেক্টরে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব কি না, এসব চিন্তার মধ্যেও চ্যালেঞ্জ নিলাম। এখানে এত সুন্দর কাজের পরিবেশ ছিল যে, চ্যালেঞ্জ অনুভব করিনি। টিমটা খুব ভালো ছিল। নতুন একজন মানুষ এসেছে তাকে গ্রহণ করে নেওয়া এমন মনোভাব ছিল সবার। আমার এখানে কখনও মনে হয়নি, আমার কথা কেউ এখানে শুনল না। আমি এখানে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে চাই, বিএটি বাংলাদেশকে। আমার ক্ষেত্রে বলতে চাই, জীবনে চ্যালেঞ্জ এসেছিল আমি মোকাবিলা করে চেষ্টা করেছি এগিয়ে যেতে। আমার স্পিরিটটাকে (উদ্দীপনা) কাজে লাগিয়ে আরও সামনের দিকে নিজেকে এগিয়ে নিতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : আজকের মুবিনা আসাফ হয়ে ওঠার গল্পটা শুনতে চাই...
মুবিনা আসাফ : আমার আব্বা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আব্বার বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিংয়ের কারণে আমাদের বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি ছোটবেলা থেকেই শিখেছি। আমার পরিবার থেকে যে কনফিডেন্সটা (আত্মবিশ্বাস) দেওয়া হয়েছে, সেটিই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। যেকোনো কিছু করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো আমি সেটা চাই কি না। আমার মনে হয়, ছোটবেলা থেকে আমার পরিবার যে কনফিডেন্স দিয়েছে, সেটা আমার সবচেয়ে বড় পুঁজি।
শহিদ আনোয়ার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে পাস (এসএসসি, এইচএসসি) করেছি। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়েছি। এরপর ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে ঢুকলাম। প্র্যাকটিস চালিয়ে গেলাম। এলাম হাইকোর্টে। প্রতিদিন হাইকোর্টের বারান্দায় ফাইল নিয়ে সিনিয়রের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করেছি। প্রায় ২৭ বছরের যাত্রা আমার। আমার দুই মেয়ে। যখন আমি মা হয়েছিলাম, সেই সময় আমার ব্রেক (অবকাশ) নিতে হয়েছিল। এরপর যখন আমি ফিরলাম পরিস্থিতিটা কিছুটা কঠিন ছিল। কারণ আমি প্রায় আট মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে আসলাম। এর আগে যেভাবে আমি কাজগুলো রেখে গেলাম সেগুলো সেভাবে নেই। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে, অনেক নতুন লোক চলে এসেছে। আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল আবার নিজের জায়গাটা তৈরি করে নেওয়া। তবে কখনও হাল ছেড়ে দেইনি। সেটা ধরে না রাখলে আজ হয়তোবা এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।
ঢাকা পোস্ট : তরুণদের উদ্দেশে মুবিনা আসাফ কী বলবেন...
মুবিনা আসাফ : নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ফ্যামিলি, ফ্রেন্ড সবার সহযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে। একা কিন্তু খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না। সঙ্গে যদি কিছু মানুষের সাপোর্ট (সহায়তা) থাকে সে এগিয়ে যাওয়া আরও সুন্দর হয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে নতুন প্রজন্মকে বলতে চাই, চ্যালেঞ্জ আসবেই, এটার সমাধান খুঁজে বের করে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব থাকলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
এএসএস/এফআর/এমএমজে
