লাগামহীন দুই লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের ঘোড়দৌড়!

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুই লোকসানি কোম্পানি জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক লিমিটেডের (আইএসএন) শেয়ারদর গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এরই মধ্যে কোম্পানি দুটির এই অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ তদন্তে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকেও বার বার সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও লাগামহীনভাবে ছুটছে শেয়ার দুটির দরবৃদ্ধির ঘোড়া।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শেয়ার যারা কিনছেন তারা হয়তো পেছনের তথ্য অগ্রিম জেনে কিনছেন। তা না হলে গুজবে কিনছেন। পেছনে ভালো কোনো তথ্য থাকলেও যে পরিমাণ উচ্চ দরে কেনা হচ্ছে, তাতে একশ্রেণির বিনিয়োগকারীকে দিনশেষে লোকসান গুনতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘উচ্চ দামে এই শেয়ারগুলো যারা কিনছে, তারা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি—যারা লোকসানি শেয়ার গুজবে কিনছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। ঠিক মতো তদন্ত হলে দেখা যাবে, কোনো একটা শ্রেণির প্রলোভনে পড়ে এই শেয়ারে আগ্রহ বাড়ছে। পরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে উচ্চ দামে ধরিয়ে দিয়ে ওই শ্রেণি বেরিয়ে যাবে।’
কোন কোম্পানি আর্থিকভাবে কতটা দুর্বল
আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্ধ-যুগের বেশি সময় ধরে লোকসানে রয়েছে জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ। শুধু ২০১৯ সালের ৩০ জুন থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানির নিট লোকসান হয়েছে ২৩ কোটি টাকার বেশি। মাত্র ৯ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ছোট এই কোম্পানিটিকে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ৩ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। আর সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) কোম্পানির প্রায় ৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অর্থাৎ লোকসানের বোঝা দিনদিন বাড়ছে।
কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের পণ্যের চাহিদা কমায় বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণে ধারাবাহিক লোকসান গুনতে হচ্ছে। এমনকি অর্থের অভাবে কোম্পানির ব্যালান্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার ও প্রতিস্থাপনের (বিএমআরই) কাজও থেমে আছে। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ চেয়েও বারবার প্রত্যাখ্যান হচ্ছে তারা।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, মাত্র ১১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কও দীর্ঘ বছর ধরে আর্থিকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। কোম্পানির রিজার্ভেও প্রায় ৮ কোটি টাকা ঘাটতি পড়েছে। শেষ কয়েক বছরের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানিটিকে ৯ কোটির বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর কয়েক বছর সামান্য পরিসরে মুনাফা করতে সক্ষম হলেও সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) কোম্পানিকে প্রায় ১৯ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাঁধে কত শেয়ারের বোঝা
দুর্বল আর্থিক অবস্থার কোম্পানি দুটোর অধিকাংশ শেয়ারই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজের মোট ৮৯ লাখ ২৮ হাজার শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতেই রয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। অন্যদিকে ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা নিজেদের কাছে বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারনেও ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানির মোট ১ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার শেয়ারের মধ্যে তাদের মালিকানার অংশ মাত্র ২১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিপরীতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা রয়েছে ৬৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
অর্থাৎ দুটো কোম্পানিতেই অধিকাংশ শেয়ারের মালিকানা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। এ অবস্থায় কোম্পানি দুটি লোকসান করলে কিংবা কোনো কারণে অবসায়নে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বছরের পর বছর নামমাত্র লভ্যাংশ
কোম্পানি দুটির মধ্যে জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিনিয়োগকারীদের মাত্র ৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। আগের দুই বছরে কোম্পানিটি আড়াই শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগের দুই বছরে দিয়েছিল ৫ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ।
অন্যদিকে ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক তাদের বিনিয়োগকারীদের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। আগের অর্থবছরে দিয়েছিল ১ শতাংশ নগদ। তার আগের বছরে ৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। এই কোম্পানিটি বিগত বছরগুলোতে নামমাত্র লভ্যাংশ ঘোষণা করে এলেও বিনিয়োগকারীদের তার পুরো অংশ বুঝিয়ে দেয়নি। গত বছরের ৩০ জুন শেষে কোম্পানির অবণ্টিত লভ্যাংশের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টাকা।
লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগকারীর প্রাপ্তি হিসাবে করে দেখা যায়, কোনো বিনিয়োগকারী যদি ৫০ টাকা দরে কোম্পানি দুটির ১ লাখ করে শেয়ার কিনে থাকে, তাহলে প্রত্যেক কোম্পানির শেয়ারের জন্য তাকে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে কোম্পানি ৩ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিলে বিনিয়োগকারী ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে বছরে পাবে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে বিনিয়োগের বিপরীতের লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার হার দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ। অথচ ব্যাংকে আমানত রাখলেই এই বিনিয়োগের বিপরীতে ন্যূনতম ৮ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বার্ষিক মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সুবিধাভোগীরা কোন শেয়ারে কত মুনাফা তুললো
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিএসইতে প্রায় ২ মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে জিকিউ বলপেনের শেয়ারদর। গত ২৯ জুন কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ১৭০ টাকা ৮০ পয়সা। গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) লেনদেন শেষে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ টাকা ৭০ পয়সায়। অর্থাৎ গত দুই মাসের কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ২২৯ টাকা ৯০ পয়সা বা ১৩৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের শেয়ারদর গত একমাসে ৬৩ টাকা অর্থাৎ ১৪৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। ২৮ জুলাইয়ের ৪২ টাকা ৭০ পয়সার শেয়ারটি গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকা ৭০ পয়সায়।
অন্যভাবে বলা যায়, যদি কোনো বিনিয়োগকারী গত ২৯ জুন জিকিউ বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজের ১ লাখ শেয়ার কিনে ১ কোটি ৭০ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। মাত্র দুই মাস পর সেই শেয়ার বিক্রি করে ওই বিনিয়োগকারী ২ কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা মুনাফাসহ মোট ৪ কোটি ৭০ হাজার টাকা তুলে নিতে পেরেছেন। আর কেউ যদি গত ২৮ জুলাই ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের ১ লাখ শেয়ার কিনে ৪২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। তবে মাত্র একমাস পর সে ৬৩ লাখ টাকা মুনাফাসহ ১ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছে।
স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কী করছে
এরই মধ্যে কোম্পানি দুটির অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ তদন্ত করতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ। এর বাইরে কোম্পানি দুটির বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে সতর্ক বার্তাও দিয়ে যাচ্ছে ডিএসই। তবে কোম্পানি দুটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের এই অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ জানা নেই। এমনকি তাদের কাছে এমন কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও নেই, যাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ার দুটির দাম এতটা বাড়তে পারে।
ডিএসইর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, জিকিউ বলপেন ও ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। কমিশন থেকেও কোম্পানি দুটির শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ তদন্ত করে দেখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডিএসই বিষয়টি তদন্ত করে কোনো অসংগতি পেলে তা প্রতিবেদন আকারে কমিশনের কাছে পাঠাবে।
এ বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোম্পানি দুটির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির বিষয়টি ক্ষতি দেখতে এরই মধ্যে ডিএসইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডিএসই বিষয়টি খতিয়ে দেখে কমিশনে রিপোর্ট জমা দিলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এমএইচ/এসএম
