পথে বসার উপক্রম ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ই-কমার্স উদ্যোক্তা কার্যত নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের বেশিরভাগেরই কোনো ইনস্যুরেন্স ছিল না। ফলে, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কেউ ৫ লাখ কেউ ৫০ লাখ টাকার পণ্য আমদানি করেছিলেন, যা এক রাতের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
সোমবার (২০ অক্টোবর) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি জানা গেছে।

বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের সামনে দেখা যায়, কার্গো ভিলেজের পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনের ফুটপাতে অবস্থান করছেন বিভিন্ন সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্ট ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভবনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি মোতায়েন রয়েছে এবং কয়েকজন কর্মী ভেতরে কাজ করছেন। পুরো এলাকা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তায় ঘেরা। কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আমদানি-রপ্তানির কাজে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ কর্মী, লজিস্টিকস শ্রমিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রায় সবাই দিশেহারা।
আরও পড়ুন
ই-কমার্স আমদানিকারকদের জন্য বড় ধাক্কা
অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন ছোট ছোট ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা। ইক্যাব ও ই-কুরিয়ার সংশ্লিষ্ট অনেক উদ্যোক্তা নিয়মিত চীন থেকে ২০ থেকে ১০০ কেজি ওজনের ছোট ছোট চালান এনে অনলাইনে বিক্রি করতেন। সেই চালানগুলো আগুনে পুড়ে গেছে।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। সংস্থাটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত
অনলাইন স্টোরের উদ্যোক্তা রুবায়েত হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চীনের গুয়াংজু থেকে ছোট ইলেকট্রনিক অ্যাকসেসরিজ এনে বিক্রি করি। শেষ চালানে প্রায় ৪০ কেজি পণ্য ছিল, যেমন- চার্জার, স্মার্টওয়াচ, হেডফোন—সবই আগুনে পুড়ে গেছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে হয়তো ছয় মাস লেগে যাবে।
তিনি বলেন, বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর তো কোনো ক্ষতি নেই, যে টাকার পণ্য পুড়েছে, তার চেয়ে বেশি টাকা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো থেকে ফেরত পাবে। যে কারণে এসব আগুনে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা যারা ছোট ব্যবসায়ী, যারা নিজ দায়িত্বে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার পণ্য আনা-নেওয়া করি, আমরা আসলে পথে বসে গেছি। এই টাকা আমাদের জন্য অনেক কিছু।

কসমেটিকস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্ল্যামহাব-এর মালিক তুহিন রহমান বলেন, এই চালানে প্রায় সাত লাখ টাকার কসমেটিকস ছিল, যা দেশে পৌঁছেও ওয়্যার হাউসে আটকে ছিল। এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সব পুড়ে গেছে।
ইনস্যুরেন্স ছিল কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ইনস্যুরেন্স ছিল না। কারণ, আমি ছোট চালান আনি।
অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বড় আঘাত ‘বিশ্বাসের জায়গায়’— জানিয়েছেন উপস্থিত ব্যবসায়ীরা। এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, আমরা গ্রাহকদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পণ্য বুক করি। এখন তাদের কী বলব? কেউ বিশ্বাস করবে না যে পণ্য আগুনে পুড়ে গেছে।
আরও পড়ুন
সিঅ্যান্ডএফ খাতে স্থবিরতা
শাজালাল বিমানবন্দরে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পণ্য ওঠানো-নামানো, কাগজপত্র তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। আগুন লাগার পর সবকিছু এখন পুরোপুরি বন্ধ ও নিস্তব্ধ। সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ এখানে কাজ করেন। এখন কাজ বন্ধ মানে তাদের উপার্জনও বন্ধ।
তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি— ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত সহায়তা দেওয়া হোক। তা না হলে শত শত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী চিরতরে হারিয়ে যাবেন।

রয়্যাল ক্লিয়ারিং হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর পুরো সিঅ্যান্ডএফ খাত কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ এখানে কাজ করেন। এখন তাদের উপার্জন শূন্য। শুধু ক্ষতি নয়, অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। কবে আবার চালান আসবে, কেউ জানে না।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত সহায়তা দেওয়া হোক। এই খাতের ওপর নির্ভর করে হাজারও পরিবার বেঁচে আছে। এই ক্ষতি সামলে না উঠলে অনেকে পেশা বদলাতে বাধ্য হবেন।
আরও পড়ুন
আগুনে ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকার
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। সংস্থাটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এ ঘটনায় প্রাথমিক হিসাবে ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু ৩২টি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের বিপরীতে বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি করার দাবি জানাচ্ছি। বিমার বাইরে অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারি বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) নেতারা। এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি ও আমদানি পণ্য নষ্ট হয়ে ব্যবসায়ী মহলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ও পর্যাপ্ত সহায়তা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
এফবিসিসিআই আশা প্রকাশ করে বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে দ্রুত পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেবে সরকার। যাতে রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত না হয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন থাকে।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ অক্টোবর দুপুর ২টা ২০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটের সাত ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে, পুরো আগুন নেভাতে সময় লেগেছে প্রায় ২৭ ঘণ্টা। পরদিন রোববার বিকেলে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা হয়।
আগুনে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি পণ্য, গার্মেন্টসের কাঁচামাল ও বিভিন্ন কনসাইনমেন্ট সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ঘটনার পর থেকে বিমানবন্দরের পণ্য পরিবহন কার্যক্রম আংশিক বন্ধ রয়েছে।
টিআই/এমজে
