এডিবির গ্যাসভিত্তিক ঋণে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে নবায়নযোগ্য খাতে

বাংলাদেশে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর প্রকল্পে বিপুল ঋণ দেওয়ার কারণে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশগত ঝুঁকি আরও বাড়ছে। অন্যদিকে, নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ উদাসীনতার কারণে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও টেকসই শক্তির সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিগত বাধা দূর না করলে নবায়নযোগ্য খাতের সম্প্রসারণ আশানুরূপ হবে না।
রোববার (৭ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরে তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ এনার্জি কনফারেন্স ২০২৫-এর দ্বিতীয় দিনে এক সেশনে এনজিও ফোরাম অন এডিবির কো-অর্ডিনেটর শারমিন আক্তার বৃষ্টি ‘বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বহুজাতিক ব্যাংক’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সেশনটি পরিচালনা করেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক রায়ান হাসান।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় মোট ৫৭০টি জ্বালানি প্রকল্পে ৯২.১ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩৬টি গ্যাসকেন্দ্রিক প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে ৫.৯৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ৩,৬৫৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
এডিবির বাংলাদেশে গ্যাস খাতে অর্থায়নের ৬০ শতাংশ এসেছে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স স্পেশাল ফান্ড থেকে, ৩৬ শতাংশ উচ্চ সুদের ওসিআর ঋণ থেকে এবং মাত্র ৪ শতাংশ এডিএফ তহবিল থেকে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এডিবি গ্যাস পরিকল্পনা, সিস্টেম উন্নয়ন ও পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কাজ করলেও ২০০০ সালের পর সরাসরি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জোর দেয়। সিরাজগঞ্জ ও মেঘনাঘাট ৪৫০ মেগাওয়াট প্লান্টের টেন্ডারও পরিচালনা করে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এডিবির বাংলাদেশে করা বিনিয়োগের বড় অংশই গ্যাস সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে যায়। ১.২৩২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে, ১.১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে, ৭০৩.৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে গ্যাস খাত উন্নয়নে, ৬৬০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে পরিকল্পনা খাতে, ৬০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে এবং ১.৩৯৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে অন্যান্য গ্যাস-সম্পর্কিত প্রকল্পে। সরকারি খাতের চারটি প্রকল্প পেয়েছে ৮১৭ মিলিয়ন ডলার আর বেসরকারি খাতের ৪১৫ মিলিয়ন ডলার গিয়েছে জিইই, পেন্ডেকার, সামিট, জেরা-রিলায়েন্স ও এনডব্লিউপিজিসিএলের প্রকল্পে।
নিষ্ক্রিয় প্রকল্প ও অতিরিক্ত ঋণঝুঁকি
গ্যাস সংকট ও পাইপলাইন অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট ও রিলায়েন্স মেঘনাঘাট ৭১৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলেও চালু হয়নি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বাংলাদেশকে ওসিআর ঋণের আওতায় উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।
রায়ান হাসান বলেন, ‘এই কেন্দ্রগুলোই জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার সবচেয়ে ব্যয়বহুল উদাহরণ– বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত কিন্তু জ্বালানি নেই।’
পিপিএ এবং ইআইএ অনুযায়ী, এডিবি-সমর্থিত পাঁচটি কেন্দ্রের মোট জীবনচক্রের কার্বন নিঃসরণ দাঁড়ায় ১৭৪.৭১ মিলিয়ন টন CO₂। এসব কেন্দ্র মেঘনা, মেঘনাঘাট ও ভৈরব নদীর তীরে ১৬০ একরের বেশি জমি দখল করেছে, যেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠী জীবিকা হারিয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে।
নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নীতিগত বাধা ও উদাসীনতার কারণে খাতের সম্প্রসারণ আশানুরূপ হচ্ছে না। আথারের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সোলার স্থাপনাগুলো বাড়ির ছাদে থাকা সোলার সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরভিত্তিক রুফটপ সোলার সিস্টেম কার্যকর নয়, এগুলো মূলত নীতি পূরণের জন্য ইনস্টল করা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নয়।
বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তাফা আল মাহমুদ বলেন, ‘নবায়নযোগ্য শক্তিতে অর্থনৈতিক রূপান্তর সার্থক করতে শক্তিশালী আর্থিক প্রণোদনার প্রয়োজন, কারণ সৌরবিদ্যুতের প্রাথমিক ব্যয় অনেক বেশি। এ ছাড়া সিস্টেমের ভেতরেও অদৃশ্য বাধা রয়েছে। কিছু নীতিমূলক উদ্যোগ থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এডিবির সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগ ১১৮ মিলিয়ন ডলার, যার মোট সক্ষমতা ২২৫.৮ মেগাওয়াট। বায়ু বিদ্যুতে বিনিয়োগ একেবারেই শূন্য। এডিবি তাদের ২০২১ এনার্জি পলিসিতে চারটি সংশোধন আনে– পারমাণবিক অর্থায়ন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ক্রিটিক্যাল মিনারেল সরবরাহ শৃঙ্খলা সমর্থন, কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি অনুমোদন এবং তেল-গ্যাস খাতে মিথেন লিকেজ ও ফ্লেয়ারিং কমাতে অর্থায়ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সংশোধন উচ্চ ব্যয় ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তির দিকে ঝোঁক বাড়াচ্ছে– যে সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রয়োজন কম ব্যয়, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই জ্বালানির দ্রুত সম্প্রসারণ।
করণীয় প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বাধা দূর করা, কার্যকর নীতি গ্রহণ এবং আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে গ্যাসভিত্তিক প্রকল্পের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
টিআই/এসএসএইচ