প্রথমে ২, তিন মাস পর পর ১ লাখ— পাঁচ ব্যাংকের আমানত ফেরতের খসড়া চূড়ান্ত

- ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ গভর্নরের
- ৬০ উর্ধ্ব ও ক্যানসার আক্রান্ত ব্যক্তি পাবেন বিশেষ সুবিধা
- প্রয়োজন ছাড়া টাকা না তোলার আহ্বান
একীভূত হওয়া সমস্যাগ্রস্ত পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে বিশেষ স্কিমের খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্কিম অনুযায়ী প্রথম ধাপে একজন গ্রাহক একবারে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা তুলতে পারবেন। এই অর্থ দেওয়া হবে আমানত বিমা তহবিল থেকে। এরপর যাদের আমানত দুই লাখ টাকার বেশি, তারা প্রতি তিন মাসে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা করে তুলতে পারবেন।
গভর্নর আহসান এইচ. মানসুরের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকে একীভূত হওয়া ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসির’ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়াকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চার ডেপুটি গভর্নর, পাঁচ সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংকের প্রশাসক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
বৈঠকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, একীভূত ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে। কারণ নতুন ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো সেই ব্যাংকের ডাটাবেজ তৈরি হয়নি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নিয়োগ করা হয়নি। ফলে আইনি একটি বাধা দাঁড়িয়েছে। তবুও গভর্নর নির্দেশ দিয়েছেন—ডিসেম্বরের মধ্যেই টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো সমাধানে কি করা যায়, এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে বিশেষ স্কিমের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়।
কিভাবে কত টাকা তুলতে পারবেন আমানতকারীরা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, যেসব গ্রাহকের হিসাবে ২ লাখ টাকা বা এর কম আছে, স্কিম কার্যকর হওয়ার পর তারা পুরো টাকা একবারেই তুলতে পারবেন।
আর যাদের হিসাবে ২ লাখ টাকার বেশি রয়েছে, তারা প্রতি তিন মাস অন্তর সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা করে দুই বছর পর্যন্ত তুলতে পারবেন।
তবে ৬০ বছরের বেশি বয়সী গ্রাহক অথবা ক্যানসার বা জটিল রোগে আক্রান্ত আমানতকারীদের জন্য এই সীমা শিথিল রাখা হয়েছে—তারা প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো পরিমাণ টাকা তুলতে পারবেন।
প্রয়োজন ছাড়া টাকা না তোলার আহ্বান
এদিকে প্রয়োজন ছাড়া টাকা তুলতে নিরুসাহিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন ব্যাংকটি সম্পূর্ণ নতুন হওয়ায় মৌলিকভাবে কোনো জটিলতা নেই। তাই সবার টাকা তোলা বাধ্যতামূলক নয়; তবে কেউ চাইলে স্কিম অনুযায়ী তুলতে পারবেন। এই স্কিমের মূল লক্ষ্য হলো আমানতকারীদের মধ্যে তৈরি হওয়া আস্থাহীনতা দূর করা এবং ধাপে ধাপে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
স্কিমের সুবিধা পেতে কি কি লাগবে
স্কিমের সুবিধা পেতে গ্রাহকের অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে খোলা বৈধ হিসাব থাকতে হবে। এক ব্যাংকে একাধিক হিসাব থাকলেও একজন গ্রাহক একটি হিসাব থেকেই এ সুবিধা পাবেন। তবে পাঁচ ব্যাংকে একজনের আলাদা আলাদা হিসাব থাকলে প্রতিটি হিসাবের বিপরীতে পৃথকভাবে টাকা পাওয়ার সুযোগ থাকবে। যেসব আমানতকারীর ঋণ রয়েছে, তারা ঋণ সমন্বয় না করা পর্যন্ত স্কিমের আওতায় টাকা তুলতে পারবেন না।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কয়েকটি প্রভাবশালী গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে ডজনখানেক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ তুলে নেয়। এসব অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির চাপেই ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে গভীর সংকটে পড়ে। এরমধ্যে সংকটে থাকা পাঁচটি ব্যাংক একত্রিত করে ‘সম্মিলিত ইসলামি ব্যাংক’ গঠনের অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো– এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসির পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২০ হাজার কোটি এবং আমানতকারীদের শেয়ার থেকে আসবে বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা। অনুমোদিত মূলধন রাখা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকে বর্তমানে ৭৫ লাখ আমানতকারীর প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা জমা রয়েছে। বিপরীতে ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে।
সারা দেশে এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। একীভূত হওয়ার পর একই এলাকার একাধিক শাখা মিলে একটি বা দুটি করা হবে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন খরচ কমাতে এরই মধ্যে কর্মীদের বেতন–ভাতা ২০ শতাংশ কমানো হয়েছে।
সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের জন্য প্রাথমিকভাবে রাজধানীর মতিঝিল সেনা কল্যাণ ভবনে অফিস নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলা হয়েছে। শিগগিরই পরিচালনা পর্ষদ গঠন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে। এর আগে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ৫ নভেম্বর প্রশাসক নিয়োগ ও ব্যাংকগুলোর শেয়ার শূন্য ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/এমটিআই
