কাজুদানা কারসাজিতে পাচার হচ্ছে দেশের টাকা

কাজুদানা ও কাজু বাদাম আমদানির কারসাজিতে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি ও অর্থপাচারের ঘটনা ঘটেছে। শুল্ক ফাঁকির উদ্দেশ্যে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা কাজু বাদাম আনার ঘোষণা দিয়ে নিম্নমানের কাজুদানা আমদানি করছে। এ প্রক্রিয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির তথ্য মিলেছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে কাজুদানার কম মূল্য দেখিয়ে অর্থপাচারের নতুন কৌশলে নেমেছে অসাধু চক্র। ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানির নতুন সম্ভাবনার পণ্য কাজুবাদামের চাষীরা।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজু বাদাম রপ্তানির বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমদানি কারসাজি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য কম দেখানো আবার অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়েও আমদানি হচ্ছে নিম্নমানের কাজুদানা। এতে সম্ভাবনাময় পণ্য কাজু বাদাম উৎপাদনকারীরা রপ্তানির ক্ষেত্রেও চরম বিপাকে পড়ছেন।
এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজুদানার পরিবর্তে কাজু বাদাম ঘোষণা দিয়ে ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাজুদানা আমদানির নামে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। চক্রটি শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি কাজুদানার দাম কমপক্ষে ৮ মার্কিন ডলার অথচ বিল এন্ট্রিতে মাত্র ১.৮৫ মার্কিন ডলার দেখানো হয়েছে।
স্বয়ং কৃষি মন্ত্রণালয় এমন ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বরাবর এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে কৃষি দপ্তর।
গত ৬ জানুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাছিমা খানম সই করা চিঠিতে উঠে আসে শুল্ক ফাঁকি ও অর্থপাচারের বিষয়টি। চিঠিতে বলা হয়, এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজুদানার পরিবর্তে কাজু বাদাম ঘোষণা দিয়ে ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাজুদানা আমদানির নামে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। চক্রটি শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি কাজুদানার দাম কমপক্ষে ৮ মার্কিন ডলার অথচ বিল এন্ট্রিতে মাত্র ১.৮৫ মার্কিন ডলার দেখানো হয়েছে।
ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি, অর্থকরী ও পুষ্টিকর এ ফসলের উৎপাদনসহ রপ্তানি পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন ওই উপসচিব।
আইন অনুযায়ী, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২ শতাংশ জরিমানার বিধান থাকলেও অবাধে এসব কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছেন আমদানিকারকরা। অভিযোগ উঠেছে, সম্ভাবনাময় এ খাত বাধাগ্রস্ত করতে অসাধু সিন্ডিকেট অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে বিদেশে অর্থপাচার করছে।
মিথ্যা ঘোষণায় কাজুদানা আমদানির বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম পুরোপুরি অবগত নন বলে জানান। তবে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান তিনি।
অসাধু চক্রটি নিজেদের স্বার্থে দেশীয় রপ্তানিকে ব্যাহত করছে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। তাদের সুবিধা দিচ্ছে কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা। তারা পরীক্ষা ছাড়াই পণ্য খালাস করছে
মু. আব্দুস ছালাম, সা. সম্পাদক, ক্যাশো গ্রোয়ার্স প্রসেসরস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন
রপ্তানি পণ্যের নতুন এ খাতের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে কিছু অসাধু আমদানিকারক কাজুবাদামের নামে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে কাজুদানা আমদানি করছে। অন্যদিকে কাজু বাদাম বলে কাজুদানা অবাধে ছাড় করছে কাস্টমস। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এসব বাধা উত্তরণে কাজু বাদাম উৎপাদন ও রপ্তানিকারকরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চেয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য এলাকায় অনেক আগে থেকে কাজুবাদামের ফলন হলেও খোসা ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার মতো কারখানা না থাকায় বাদামের কদর ছিল কম। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠে। ২০১০-১১ অর্থবছরে কাঁচা কাজুবাদামের একটি চালান রপ্তানির পরই এর প্রতি দৃষ্টি পড়ে অনেকের। প্রতি টন কাজুবাদামের রপ্তানিমূল্য প্রায় ১১০০ মার্কিন ডলার। এরপর কৃষকরা চাষে আগ্রহী হন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে যেখানে ৯৬২ টন ফলন হয়, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩২৩ টনে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে ফলন বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কাজু বাদাম রপ্তানিকারকদের সংগঠন ক্যাশো গ্রোয়ার্স প্রসেসরস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মু. আব্দুস ছালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু অসাধু আমদানিকারক রপ্তানি ও উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে কাজুবাদামের নামে কম মূল্যে কাজুদানা আমদানি করছে। বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি কাজু দানা ৮ ডলারের বেশি হলেও তারা দেড় ডলার মূল্য দেখিয়ে আমদানি করছে। ইতোমধ্যে আমরা এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নিয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বান্দরবানে এখন আট লাখ ৬৯ হাজার কাজুবাদামের গাছ রয়েছে। প্রতি বছরই গাছের সংখ্যা বাড়ছে। যে হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়বে। পার্বত্য এলাকার পাশাপাশি বরেন্দ্র অঞ্চলেও কাজু বাদাম চাষের প্রক্রিয়া চলছে। কাজু বাদাম চাষীর সংখ্যা ও উৎপাদনের পরিমাণ প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, টাঙ্গাইল, শেরপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, সিলেট, মৌলভীবাজার ও বরেন্দ্র এলাকায় প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমি কাজু বাদাম চাষের আওতায় এনে ১৫ লাখ টন কাজু বাদাম উৎপাদন করা।
আরএম/ওএফ/এমএআর
