ত্যাগে গড়া, কষ্টে ভরা এক জীবন

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে শত শত হিফজ মাদ্রাসা। যেখানে শিশু-কিশোরদের মুখে মুখে ধ্বনিত হয় কোরআনের আয়াত। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে মুখস্থ করার নিরন্তর অনুশীলন। এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরা এক-একজন কোরআনের আলোকবর্তিকা, যাদের ত্যাগ ও পরিশ্রমেই গড়ে ওঠে দেশের হাজারও হাফেজ। কিন্তু আলো বিলানোর এই মানুষগুলো নিজেরা থাকেন গভীর অন্ধকারে; অর্থনৈতিক বঞ্চনা, সামাজিক অবহেলা আর অনিশ্চিত জীবনের ঘেরাটোপে।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ হিফজ মাদ্রাসায় কোনো নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই। অনেক শিক্ষক মাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় পুরো সময় কাজ করেন। কেউ কেউ আবার কোনো বেতনই পান না। মাদ্রাসার দান-অনুদান থেকে অনিয়মিতভাবে যা আসে, তা দিয়েই চলে সংসার। অনেকের পরিবার এই সামান্য আয়ে টিকে থাকতে পারে না। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করার চেষ্টা করেন তারা।
মাদ্রাসার শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় কোনো সহায়তা বা নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেই। ফলে তাদের জীবনযাপন নির্ভর করে কেবল মানুষের দান ও সদিচ্ছার ওপর। ধর্মীয় শিক্ষাকে সরকার নানা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করলেও হিফজ মাদ্রাসাগুলোর জন্য কোনো একক নীতিমালা বা বেতন কাঠামো নেই। মাদ্রাসাগুলো সাধারণত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা স্থানীয় অনুদানে পরিচালিত হয়। ফলে শিক্ষক নিয়োগ, বেতন, ছুটি— সবকিছুই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের সদিচ্ছার ওপর
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার একটি হিফজ মাদ্রাসায় পড়ান হাফেজ মাহবুবুর রহমান। বেতন চার হাজার টাকা। সকাল ৭টায় মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন, কখনও কখনও রাত ৯টা পর্যন্ত থেকে যান ছাত্রদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা যখন সাবলীলভাবে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারে, তখন মনে হয় আমার পরিশ্রম সফল হয়েছে। কিন্তু মাসের শেষে যখন বাজারে যাই, তখন বাস্তবতা অন্য কথা বলে।’

‘স্ত্রী সেলাইয়ের কাজ করে সংসারে কিছুটা সহায়তা করেন। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে প্রায়ই ধার করতে হয়।’
নারায়ণগঞ্জের আরেক শিক্ষক হাফেজ আনিসুর রহমান। তিনি একটানা ১২ বছর ধরে পড়াচ্ছেন। কিন্তু এখনও স্থায়ী কোনো বেতন নেই। কখনও তিন হাজার, কখনও চার হাজার— দানদাতারা যা দেন তাই মেনে নিতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা কোরআনের শিক্ষক, তাই চুপ করে থাকি। কিন্তু পরিবারে চাপ বাড়ছে। মাঝেমধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তারপরও ধৈর্য ধরে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি।’
নিজামুল ইসলাম নামের আরেক শিক্ষক জানান, দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। একসময় ভেবেছিলেন অন্য কাজ করবেন, কিন্তু নিজেকে সেই পথে নিয়ে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমি ছাত্রদের কোরআন শেখাই, এটা আল্লাহর কাজ। পেটের কষ্ট আছে, তবু এই কাজ ছেড়ে দিতে মন চায় না।’
মূলত, এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় কোনো সহায়তা বা নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেই। ফলে তাদের জীবনযাপন নির্ভর করে কেবল মানুষের দান ও সদিচ্ছার ওপর। ধর্মীয় শিক্ষাকে সরকার নানা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করলেও হিফজ মাদ্রাসাগুলোর জন্য কোনো একক নীতিমালা বা বেতন কাঠামো নেই। মাদ্রাসাগুলো সাধারণত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা স্থানীয় অনুদানে পরিচালিত হয়। ফলে শিক্ষক নিয়োগ, বেতন, ছুটি— সবকিছুই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের সদিচ্ছার ওপর।
আরও পড়ুন
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের হাফেজদের সাফল্য
প্রায় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোরআনের আলো ছড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকাকে উঁচু করছেন হাফেজরা। ২০২৪ সালেও এক নারীসহ মোট ১৫ জন হাফেজ আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে এনেছেন। তারা সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর, ইরান, কুয়েত, সেনেগাল, তানজানিয়া ও কাতারসহ বিশ্বের নানা দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন ও কিরাত প্রতিযোগিতায় বিজয় অর্জন করেছেন।
রাজধানীর তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহ, মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল ইসলামি ও মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই প্রধানত এ অর্জনের নায়ক।
বছরের শুরুতে কাতারে অনুষ্ঠিত তিজান আন নূর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে যাত্রা শুরু করেন ক্ষুদে হাফেজ মুশফিকুর রহমান। এরপর ধারাবাহিকভাবে হাফেজ বশির আহমাদ (ইরান), হাফেজ হুজাইফা (তানজানিয়া), হাফেজ আবু রায়হান (সেনেগাল) এবং হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ ও আনাস বিন আতিক (সৌদি আরব) একে একে জয় এনে দেন।

এছাড়া হাফেজ আনাস মাহফুজ (কুয়েত), হাফেজ মাহমুদুল হাসান (তুরস্ক), ক্বারি আবু জর গিফারী (কিরাত প্রতিযোগিতা) এবং নারী হাফেজ হুমাইরা মাসউদ (মিশর) বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে ছিলেন না বাংলাদেশের হাফেজরা। হাফেজ সাদিকুর রহমান, হাফেজ জাকারিয়া ও হাফেজ আকমাল আহমাদ বিভিন্ন দেশের অনলাইন প্রতিযোগিতায় বিজয় অর্জন করেন।
মাদ্রাসার শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় কোনো সহায়তা বা নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেই। ফলে তাদের জীবনযাপন নির্ভর করে কেবল মানুষের দান ও সদিচ্ছার ওপর। ধর্মীয় শিক্ষাকে সরকার নানা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করলেও হিফজ মাদ্রাসাগুলোর জন্য কোনো একক নীতিমালা বা বেতন কাঠামো নেই। মাদ্রাসাগুলো সাধারণত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা স্থানীয় অনুদানে পরিচালিত হয়। ফলে শিক্ষক নিয়োগ, বেতন, ছুটি— সবকিছুই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের সদিচ্ছার ওপর
শিক্ষাবিদ ও পরিচালকদের বক্তব্য
তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহ মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ ক্বারি নাজমুল হাসান বলেন, ‘গ্রামীণ এলাকার শিক্ষকরা অত্যন্ত কষ্ট ও সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে জীবনযাপন করেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া, হুফফাজুল কুরআন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে বসে একটি সমন্বিত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য যে সম্মান বয়ে আনছে, তা সত্যিই গর্বের। আমি বিশ্বাস করি— যদি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা আরও বৃদ্ধি করা যায়; তারা যদি আরও নিষ্ঠা, আত্মনিবেদন ও ভালোবাসা দিয়ে কাজ করেন তাহলে বাংলাদেশের সুনাম ও সুখ্যাতি আরও উজ্জ্বল করতে পারবেন।’
অন্যদিকে গবেষকরা বলেছেন, হিফজ মাদ্রাসা আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ রাষ্ট্রীয় নজরদারি বা ন্যূনতম নীতিমালা নেই। ফলে শিক্ষকরা একেবারে অব্যবস্থাপনার মধ্যে কাজ করেন।
আরও পড়ুন

শিক্ষাবিদ ও ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই. কে. সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘বেসরকারি এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষকরাও দেশের শিক্ষাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের অনেকেই সীমিত আয় নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনে। এই শিক্ষকদের প্রতি সরকারের মানবিক ও কাঠামোগত সহায়তা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। শিক্ষকদের দাবি আন্দোলনে রূপ নেওয়ার আগেই রাষ্ট্রের উচিত তাদের কথা শোনা এবং বাস্তবসম্মত সমাধান দেওয়া।’
গ্রামীণ এলাকার শিক্ষকরা অত্যন্ত কষ্ট ও সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে জীবনযাপন করেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া, হুফফাজুল কুরআন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে বসে একটি সমন্বিত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে
হাফেজ ক্বারি নাজমুল হাসান, পরিচালক, তাহফিজুল কুরআন ওয়াসসুন্নাহ মাদ্রাসা
“শিক্ষকরা যেন মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারেন— এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ন্যায্য বেতন, চিকিৎসা সুবিধা, বাসাভাড়া ও পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য সরকারি উদ্যোগগুলো ‘সহায়তা’ নয়, বরং ‘অধিকার’ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের জীবনের স্থিতিশীলতা ও সম্মান নিশ্চিত হলেই তারা আরও নিবেদিত হয়ে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবেন। একই সঙ্গে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা জরুরি।”
আরএইচটি/এমএআর/এমজে
