পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির ৫ কারণ, ব্যবস্থা চায় দুদক

FM Abdur Rahman Masum

২১ মার্চ ২০২৩, ০৫:৩৪ এএম


পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির ৫ কারণ, ব্যবস্থা চায় দুদক

পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহণে নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে গরমিল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার দায়ভার বর্তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর।
 
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক টিমের গবেষণা ও অনুসন্ধানে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ হতে যাওয়া সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসেবে বিষয়টি থাকছে বলে জানা গেছে।

প্রতিবেদনে ছয়টি উৎস চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের আলোকে প্রতি বছর দুদক সুপারিশ তৈরি করে। সেগুলো বিবেচনা করার জন্য প্রতিবেদন আকারে সরকারের কাছে পাঠানো হয়।
 
পরিবেশ অধিদপ্তরের দুর্নীতির উৎসগুলো হলো-
 
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি
 
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখানে গরমিল পরিলক্ষিত হয়। 'নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ' শীর্ষক প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাজ করে বা কোনো কাজ না করে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরির মাধ্যমে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। দুদকের অনুসন্ধানে 'বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রেংথেনিং প্রজেক্ট’সহ বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্যতার তথ্য রয়েছে।

আরও পড়ুন >> দুদকের জাল ছিঁড়ে মুক্ত ৮৪ সরকারি কর্মকর্তা!

এছাড়া কক্সবাজার ও হাকালুকি হাওরে কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট ও ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে থ্রি-আর (রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল) প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। ওই প্রকল্পটির জন্য প্রায় ২২ কোটি টাকার প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। এছাড়া বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীর বর্জ্য অপসারণ, বরিশাল-খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সহনীয় গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে শত কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবে তা দৃশ্যমান হয়নি।
 
দুদকের অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী সেচ প্রকল্পের (ইছামতি ইউনিট) জন্য প্রায় ২১ কোটি টাকার প্রাক্কলন তৈরি এবং উপকূলবর্তী এলাকায় স্থায়ী পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন ও গাণিতিক মডেল সমীক্ষা প্রকল্প, সারা দেশে বাস্তবায়িত ‘প্রোগ্রাম্যাটিক সিডিএম' শীর্ষক প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক টিম।
 
ইটভাটার লাইসেন্স ও শিল্পের পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদানে দুর্নীতি
 
দেশে ইটভাটার লাইসেন্স ও পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০-সহ বিভিন্ন বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ইটভাটার মালিক আইনের কতিপয় সুবিধা বলে কংক্রিট, কম্প্রেসড ব্লক ইট প্রস্তুত করার নামে ইটভাটা নির্মাণ করে কৃষিজমি, পাহাড়, টিলা, মজা পুকুর, চরাঞ্চল ও পতিত জায়গা থেকে মাটি কেটে ইট প্রস্তুত করছে বলে দুদক টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

dhakapost

আরও পড়ুন >> পৌনে ৩ কোটি টাকার সম্পদে ফাঁসলেন স্ত্রীসহ পুলিশ কর্মকর্তা

টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করে আরও দেখতে পায় যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এ সংক্রান্ত আইনের বিধান দ্বারা নিষিদ্ধ এলাকাসমূহে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। লাইসেন্স গ্রহণের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইটভাটা স্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশের বিপর্যয় সাধন করছে। এমনকি ইটভাটায় ফিক্সড চিমনি, জিগজ্যাগ, হাইব্রিড, অটোমেটিক ইত্যাদি উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তরের নামে অর্থব্যয় দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
 
ছাড়পত্র ও নবায়নের মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ
 
পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্তাবলি সম্পূর্ণভাবে পরিপালন না করে অসদুপায় অবলম্বন করে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয়। দুদকের সরেজমিন পরিদর্শনে বেশির ভাগ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে ইটিপি পাওয়া যায়নি। ফলে বর্জ্য পরিশোধনের অভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ। বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় নিয়ম-নীতি ও শর্ত ভঙ্গ করে বড় অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়নের মাধ্যমে কর্মকর্তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক সময় অফিস কক্ষে বসেই সকল ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়ন করা হয়। বিভিন্ন হোটেল ও করাতকল স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়। এছাড়া অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রেও বড় অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ করা হয়।

dhakapost
 
পরিবেশ বিধ্বংসী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা না নেওয়া
 
বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশসমূহে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও বেআইনি সুবিধা গ্রহণের প্রতুলতায় এক শ্রেণির সুবিধাভোগী মহল দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে হিডেন ইকোনোমিকে শক্তিশালী করছে। যার সুবিধা সরকার বা জনগণ ভোগ করতে পারে না। অথচ ওই সব শিল্প-কারখানাসমূহে গাছ, কাঠ, গ্যাস, কয়লা, মাটিসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের অসংখ্য উপাদান ব্যবহৃত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সম্পৃক্ত দাপ্তরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই স্বার্থান্বেষী মহল বিধি-বহির্ভূতভাবে যত্রতত্র শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে। এসব শিল্প-কারখানা থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ও নির্গত বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশের বিপর্যয় সাধন করছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিম ১৫ ধরনের সুপারিশ করেছে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। যার মধ্যে রয়েছে- সকল ধরনের ইটভাটা নির্মাণ ও ইট/ব্লক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রাখা; বিভিন্ন শিল্পকারখানা, হোটেল-মোটেলসহ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের পূর্বে ইটিপি স্থাপন নিশ্চিত করা; পরিবেশ রক্ষায় আধুনিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিতে নিরপেক্ষ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করা; অনিয়ম ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা

এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব, টপ লেভেল কমিটমেন্ট এবং যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব।

আরও পড়ুন >> ঢাকা ওয়াসায় সমিতির ৩৫৫ কোটি টাকা নয়-ছয়!

এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিম ১৫ ধরনের সুপারিশ করেছে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। যার মধ্যে রয়েছে- সকল ধরনের ইটভাটা নির্মাণ ও ইট/ব্লক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রাখা; বিভিন্ন শিল্পকারখানা, হোটেল-মোটেলসহ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের পূর্বে ইটিপি স্থাপন নিশ্চিত করা; পরিবেশ রক্ষায় আধুনিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিতে নিরপেক্ষ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করা; অনিয়ম ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

dhakapost

এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের অনুসন্ধানে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগসাজশের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি; শক্তিশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব এবং জনসম্পৃক্ততায় ঘাটতির বিষয়টি বেশি চোখে পড়েছে।
 
প্রসঙ্গত, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৯ (১) ধারা অনুযায়ী প্রতি বছর রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
 
আরএম/এফকে

Link copied