নারী-পুরুষ নয়, কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকলে সফলতা আসবেই
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মর্যাদাপূর্ণ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছেন সেনা কর্মকর্তা নিশাত জুবাইদা। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাকে মেজর জেনারেল র্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজিতে (এএফআইপি) দ্বিতীয় নারী কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন নিশাত জুবাইদা। দীর্ঘ আলাপে কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার গল্প উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নূর মোহাম্মদ।
আরও পড়ুন >> আজও মেয়েদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়
ঢাকা পোস্ট : সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল হিসেবে সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন?
নিশাত জুবাইদা : খুবই ভালো লাগছে। নতুন পদ, নতুন দায়িত্ব; অন্যরকম আনন্দ অনুভব করছি। এ জন্য প্রথমে আমি মহান আল্লাহ-তালার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রদ্ধেয় সেনাপ্রধানের প্রতিও।
ঢাকা পোস্ট : সেনাবাহিনীতে আসার গল্পটা যদি শোনাতেন...
নিশাত জুবাইদা : ছোটবেলা থেকে অ্যাডভেঞ্চার, সিস্টেমেটিক লাইফ পছন্দ ছিল। এর সঙ্গে ইউনিফর্ম আমাকে খুব টানত। সেনাবাহিনীর নিয়ম, ডিসিপ্লিন, কর্তব্যবোধ আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে ইন্টার্নশিপ শেষ করার পরই সেনাবাহিনীতে নারী ডাক্তার নিয়োগের একটি সার্কুলার দেখে বাবার সম্মতি চাই। তার সম্মতির পর আবেদন, প্রিলিমিনারি, আইএসএসবি; এরপর ফাইনাল ভাইভায় উত্তীর্ণ। এই তো, সেনাবাহিনীতে পথচলা শুরু।
ঢাকা পোস্ট : কোন গুণাবলী আপনাকে এ পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে?
নিশাত জুবাইদা : নিজের আলাদা কোনো গুণাবলী এ পদে আসতে কাজ করেনি। যেটুকু আমি অনুভব করি, কর্মজীবনে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু শতভাগ সঠিকভাবে পালন করেছি। কাজের প্রতি একাগ্রতা আর ভালোবাসা থাকলে সফলতা আসবেই। সফলতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোনো বিভেদ নেই। অটুট আগ্রহ, দৃঢ় সংকল্প থাকলে সফলতা এক দিন ধরা দেবেই। সিনিয়র-জুনিয়র সহকর্মীদের চমৎকার সম্পর্ক রক্ষা করে টিমওয়ার্কে কাজ করেছি। এটাই হয়তো আমার পদোন্নতিতে কাজ করেছে।
ঢাকা পোস্ট : সেনাবাহিনীতে নারীদের আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় কি না?
নিশাত জুবাইদা : আমি-তো একজন নারী, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু কাজটা যখন করি তখন একজন অফিসার হিসেবে করি। সবাইকে তা-ই করা উচিত। যে কোনো প্রফেশনে এটাই হওয়া উচিত। সেনাবাহিনীতে নারী বা পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই। নারী হিসেবে নয়, সহকর্মী হিসেবে সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই নারী হিসেবে আমাকে আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি।
আরও পড়ুন >> ‘মেলা লোকে খারাপ খারাপ কাথা কহিচে, মুই কোনো শুনুনি’
ঢাকা পোস্ট : যেসব নারী সেনাবাহিনীতে আসতে চান তাদের উদ্দেশে আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
নিশাত জুবাইদা : সব সার্ভিসে নারীদের আলাদা কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। সেনাবাহিনীতে চ্যালেঞ্জটা অবশ্য একটু ভিন্ন রকম। সার্ভিসের বাইরেও আমাদের অনেক প্রফেশনাল কাজ করতে হয়। তাই যারা ডিসিপ্লিন, ইউনিফর্ম ও সিস্টেমেটিক লাইফ পছন্দ করেন তারা সেনাবাহিনীতে আসতে পারেন। নতুনদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, নিজের দায়িত্বের প্রতি ডেডিকেটেড থাকবেন। চাকরির প্রতি যত্নবান হতে হবে। সেনাবাহিনীর নিয়মকানুন মেনে চলবেন।
ঢাকা পোস্ট : শান্তিরক্ষী মিশনের আপনার কাজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সেখানে নারীদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়?
নিশাত জুবাইদা : ২০০৮-০৯ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে লাইবেরিয়া যাই। মেডিকেল টিমের সঙ্গে প্যাথলজিস্টের পাশাপাশি ডিউটি অফিসার হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। শান্তিরক্ষীদের চিকিৎসা দেওয়ার পর আউট স্টেশনে স্থানীয়দেরও চিকিৎসা দিতাম। খুবই রিমোট পরিবেশ, একবারও মনে হয়নি নারী হিসেবে আমাকে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে। একটা পরিবারের মতো আমরা ছিলাম।
ঢাকা পোস্ট : সেনাবাহিনীতে নারীদের পরিধি অনেক বেড়েছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?
নিশাত জুবাইদা : সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, এটা খুব পজিটিভ দিক। আমার সময়ে সেনাবাহিনীতে শুধু মেডিকেল কোরে ডাক্তার-নার্স নিয়োগ হতো। ২০০৭ সাল থেকে অন্যান্য কোরেও নারীরা আসছেন। তারাও খুব চমৎকারভাবে সার্ভিস দিচ্ছেন। তাদের ভালো কাজ দেখে একজন নারী হিসেবে আমিও গর্ববোধ করি। আমাদের সময়ে নারী ডাক্তারের কিছু স্বল্পতা ছিল, কাজের চাপ বেশি ছিল। পরবর্তীতে বিপুল সংখ্যক নারী সেনাবাহিনীতে এসেছেন। পরিস্থিতিটা সে সময়ের চেয়ে এখন অনেক কমফোর্টেবল।
আরও পড়ুন >> একটি মাত্র কম্পিউটার থেকে তিনশ কর্মী সাবিনার
সব সেক্টরে নারীরা নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছেন, যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে প্রশংসিত হচ্ছেন। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন, এটাই এখন চরম বাস্তব সত্য। প্রধানমন্ত্রী নারীদের ক্ষমতায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন, সবমিলিয়ে নারীরা পিছিয়ে নেই। পরিবারের সঙ্গে নারীরাও এখন সচেতন, তা-ই যতটুকু বাধা-বিপত্তি আছে সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাবে।
ঢাকা পোস্ট : চাকরির সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সমন্বয় কীভাবে করেছেন?
নিশাত জুবাইদা : কর্মজীবনে একজন নারীকে সার্ভিসের পাশাপাশি পরিবারকে সামলাতে হয়। এই দুটা সমন্বয় করাই একজন নারী চাকরিজীবীর প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্যক্তিজীবনে কিছু জিনিস তো সমন্বয় করেই চলতে হয়। যেমন- আমাকে সার্ভিস ও পরিবার সামলানোর পাশাপাশি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনসহ আরও একাডেমিক পড়ালেখা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর অনেক প্রফেশনাল কাজ; বাচ্চাদের দেখাশোনা, পড়ালেখা, এরপর রান্নাও করেছি। রান্না আমার একটা পেশন। নিজ হাতে রান্না করে পরিবারের সদস্যদের খাওয়ানো, এতে আলাদা একটা আনন্দ আছে। চেষ্টা ও ইচ্ছা ছিল বলেই সব হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন >> বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হতে কি কি যোগ্যতা লাগে
আমার স্বামীও একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তার কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। চাকরিজীবনে যেখানেই ছিলাম বাচ্চাদের সঙ্গে রেখে নিজে পড়িয়েছি, শিক্ষকও রেখেছি। এক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতাও পেয়েছি দারুণভাবে। সবার সহযোগিতা না পেলে হয়তো এত দূর আসতে পারতাম না।
ঢাকা পোস্ট : কর্মজীবী নারীদের প্রতি কী পরামর্শ থাকবে আপনার?
নিশাত জুবাইদা : কর্মজীবী নারীদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, বাচ্চারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে— বিষয়গুলো সতর্কভাবে খেয়াল রাখা। বিশেষ করে ছেলে বাচ্চাদের প্রতি। আমি আমার ছেলেকে সবসময় বলি, নারীদের প্রতি সম্মান দেখাবে। তোমার সামনে কোথাও নারীর প্রতি বিরূপ আচরণ বা অন্য কিছু হলে সেখানে তুমি যদি হাসো তার মানে তুমি সেটাতে অংশগ্রহণ করলে। আমি তখনই একজন ব্যর্থ মা হব যদি তুমি সেখানে একটা মুচকি হাসিও দাও। তুমি চেষ্টা করবে সেটা থামানোর, না পারলে নীরবে চলে আসবে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার শৈশব ও পড়াশোনা কোথায়?
নিশাত জুবাইদা : শৈশব ঢাকায় কেটেছে। ছোটবেলা একটু দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। পড়ালেখার চেয়ে খেলাধুলার প্রতি বেশি মনোযোগী থাকায় বাবা-মার কাছ থেকে বকাও খেতাম। এইচএসসির পর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করি।
ঢাকা পোস্ট : এ অবস্থানে পৌঁছাতে সবচেয়ে বেশি কার অবদান বলে মনে করেন?
নিশাত জুবাইদা : এখানে আসার ক্ষেত্রে কারও অবদান আমি ছোট করে দেখতে চাই না। প্রথমে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন মা-বাবা। ওনাদের অবদান তো অনস্বীকার্য। এছাড়া পরিবারের প্রতিটি সদস্য এমনকি আমার বাসার কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের কথাও আমি বলতে চাই। আমার সিনিয়র, কোর্সমেট, জুনিয়র সহকর্মী— সবার সহযোগিতা রয়েছে। যেকোনো একটা অবস্থানে আসতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে আমি কারও অবদান খাটো করে দেখতে চাই না।
আরও পড়ুন >> বৈশ্বিক সামরিক শক্তি সূচকে ৪০তম বাংলাদেশ
ঢাকা পোস্ট : অবসরের পর কী করবেন?
নিশাত জুবাইদা : অবসরে যাওয়ার পর চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো কীভাবে মানবতার সেবায় কাজে লাগানো যায়, সে চেষ্টা থাকবে। তবে, আমার পড়াতে, স্টুডেন্টদের সঙ্গে আলাপ ও মোটিভেশনাল কথা বলতে ভালো লাগে। যেহেতু পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা আছে তাই হয়তো স্টুডেন্ট পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতেও পারি। সেটা সময়ই বলে দেবে।
এনএম/এসকেডি/এমএ